এক মুহূর্তের জন্য চোখ দুইটি বন্ধ করুন। বাবার হাতের আঙুল ধরে হাঁটার অনুভূতি একবার মনে করার চেষ্টা করুন কিংবা বাবার চওড়া কাঁধের উপর উঠে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতিগুলো। যারা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত, প্রত্যেকে একবার ভেবে দেখুন বাবার হাত ধরে স্কুলে যাবার দিনটির কথা। আমরা অধিকাংশই নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য প্রত্যেকের বাবাকেই দিন রাত শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়। কয়েকদিন আগে একটি পত্রিকায় দেখলাম, ৮০ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ মানুষ পেটের জন্য রিক্সা চালাচ্ছে। সন্তানরা বিভিন্ন কাজ করে, বাবার খোঁজখবর নেয় না। আর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানরা তাদের বাবাকে সযত্নে রেখে আসছেন বৃদ্ধাশ্রমে। যে বাবা একসময়ে ভালো চাকরি করেছেন , সন্তানকে দিয়েছেন সবচেয়ে দামী জামা-কাপড়, পড়িয়েছেন সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সেই সন্তানই সমাজের একজন হয়ে আজ নিজের বাবার খোঁজ নেয় না। সন্তানদের কিসের নেশায় পেয়েছে বোঝা দায়। যে বাবা সন্তানের অসুস্থার সময় চিকিৎসা খরচ জোগাড় করতে দিন রাত এক করে পরিশ্রম করেছেন, আজ তার চিকিৎসার সময় সন্তানের নানা অজুহাত। বৃদ্ধ বাবার মৃত্যু কামনা করে এমন সন্তানও আছে আমাদের সমাজে। কত নির্বোধ আমরা!
দুই.
ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে ওঠা পুত্রের কাছে পিতার লেখা চিঠি যে কোন কঠিন হৃদয়ের মানুষের চোখেও জল এনে দেবে। চিঠির উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরছি, ‘প্রিয় সোনামানিক, তুমি কেমন আছো একথা জিজ্ঞাসা করা সম্পূর্ণ নিরর্থক মনে করছি। তুমি ভাবছো হয়ত তোমার বাবা আগের মত তোমায় ভালোবাসে না। যদি এটা ভেবে থাক তবে তোমার সেই ছোট্টবেলার মত আরেকটি ভুল করলে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি তুমি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো আছ কেন না আমার দোয়া যার সাথে সর্বদা জড়িয়ে থাকে সে খারাপ থাকতে পারে এটা আমি বিশ্বাস করিনা।
তোমার হতভাগ্য-হতদরিদ্র জন্মদাতা তোমার চাহিদা তো দূরের কথা মৌলিক চাহিদাও সম্পূর্ণভাবে পূরণ করতে পারেনি কিন্তু তুমি তো গরীব নও। সুতরাং ছেলে-মেয়ের কোন শখ যেন অপূর্ণ না থাকে। তোমাদের দোয়ায় আমিও অনেক ভালো আছি। পাশের রুমের গণি মিয়া আমার সুখ দেখে ঈর্ষা করে কেননা তুমি প্রতি বছর দু’ইবার আমার কাছে ছুটে আস। তোমার ব্যস্ততা রেখে তোমাকে আসতে বারবার নিষেধ করি তারপরও তুমি কেন আস তা আমি বুঝতে পারি না। এটা ভেবোনা যে, তুমি না আসলে আমি তোমায় ভুলে যাব কিংবা কম দোয়া করবো বরং তোমাদের প্রতি দোয়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়তেই থাকবে। কেননা দিন দিন যেভাবে অক্ষম হয়ে যাচ্ছি তাতে আমার পৃথিবীটা সংকুচিত হতে হতে আমার এক চোখ ভাঙা চশমাটির মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফসোস বেচারা গণি মিঞার জন্য! ওর সন্তানগুলো ওকে এখানে রেখে যাওয়ার পর একবারও খোঁজ নেয়নি; শুধু টাকা পাঠানো ছাড়া। প্রিয় পুত্রধন!
এখানে যে ছেলেটা আমাদের দেখাশুনা করে সে ছেলেটার মত ছেলে খুব কম দেখা যায়। ওর সম্পর্কে বললে তোমার মনে হবে এই জগতেও এমন বোকা ছেলে আছে! সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কিংবা গভীর রাতে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করে, কাকা! কিছু লাগবে? ওর আচরণে তোমার অনুপস্থিতিতে বুকের মধ্যের শূন্যতা কেমন যেন পূর্ন হয়ে যায়। ছেলেটা খুব গরীব। দিনরাত পরিশ্রম করে এখান থেকে যা মাইনে পায় তা দিয়েই ওর বাবা-মা এবং স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলতে হয়। আমি মনোযোগ দিয়ে ওর কষ্টের কথা শুনি; আমার মত অক্ষম-অলসের এর বাইরে তো আর কোন কাজ থাকে না। আমার ইচ্ছা হয় ওকে কিছু বাড়তি টাকা দেই। কিন্তু আমার সে সাধ্য তো নাই। ছেলেটাকে বলেছিলাম ওর বাবা-মাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসতে। এ কথাশুনে ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলেছে, রক্ত বিক্রি করে হলেও বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখবে; কোনদিন বৃদ্ধাশ্রমে দিবে না। ছেলেটার কথা শুনে ভেতরটা হঠাৎ মুচড়ে গিয়েছিল কিন্তু ক্ষণিক পরেই বুঝলাম আমি হয়ত আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছি! তাই এ নিয়ে আর ও ছেলেটার কাছে কিছু বলতে যাইনি। অল্পশিক্ষিত একটি ছেলে তার বাবা-মাকে নিয়ে যা ভাবছে সেটা কেবল আবেগের কথা!’
তিন.
আজিজুল ইসলাম (ছদ্মনাম) সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে চাকরি জীবন শেষ করেন। অবসর জীবনের বয়স প্রায় ১৩ বছর। স্ত্রী মারা গেছেন আজিজুল ইসলামের বয়স যখন ৩৮ বছর। দুইটি সন্তানকে ঠিকমত মানুষ করার জন্য আর বিয়ে করেন নি। সন্তান দুইটি অনেক বড় হয়েছেন। একজন অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং অন্যজন সৌদি আরবের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। অনেক নামকরা দুইজন। ভীষণ ব্যস্ত তারা। বাহাত্তর বছর বয়স্ক বাবার খোঁজ খবর নেবার সময় নেই তাদের। দুই মাস পরপর বাবার ব্যাংক হিসেবে তারা টাকা পাঠায়। আজিজুল স্যার ব্যাংক থেকে টাকা তোলেন না। সন্তানদের জন্যই রেখে দিয়েছেন, যদি ভবিষ্যতে তাদের কোন কাজে আসে। বয়সের ভারে নিজের পেনশনের টাকা তোলা , বাজার করা, দরকারি জিনিসপত্র কেনা, কাপড় ধোয়াসহ বাড়ির সবকিছু দেখভাল করা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। হৃদরোগ, ডায়াবেটিকসসহ বিভিন্ন রোগতো আছেই। প্রতিবেশিরা প্রায়ই বলে, সন্তানদের কাছে চলে গেলেই তো পারেন। আজিজুল স্যার প্রতিবেশিদেরও বলতে পারেন না সন্তানদের অনীহার কথা। অনেক বার চেষ্টা করেছেন সন্তানদের কাছে যাবার। নাতি নাতনীদের সাথে সময় কাটাবার। কিন্তু সন্তানরা চায় না। বৃদ্ধ বয়সে একাকীত্ব যে কত বড় যন্ত্রণার, সে কথা কাউকে বলা যায় না। নিজের একাকীত্ব দূর করার জন্য আজিজুল স্যার চলে এসছেন বৃদ্ধাশ্রমে। দুঃখ করেই স্যার একদিন বলেছিলেন, সন্তানদের বেশি বড় মানুষ করতে নেই। আপন থাকে না, পর হয়ে যায়।
চার.
আধুনিকতার নামে আমরা সত্যিই বর্বর হয়ে যাচ্ছি। বড় বাড়িতে বাবার থাকার জন্য সামান্য একটু জায়গা আমরা দিতে পারছি না, লক্ষ টাকা আয় করেও বাবা বিনা চিকিৎসায় যদি দিনের পর দিন পার করে, তবে সন্তান থাকার চেয়ে না থাকাই যে ভালো। বাবা কি সারাটা জীবন কষ্ট করার জন্যই পৃথিবীতে আসে? চাকরি জীবনে সন্তানের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে নিজের স্বাদ কখনও পূরণ করতে পারেনা, বৃদ্ধ বয়সেও যদি সন্তানের অবহেলা সহ্য করতে হয়, তবে সন্তান দিয়ে কি হবে? আমরা যারা সন্তান, একবারও ভাবছি না, আমাদের শরীরের এই শক্তি একদিন থাকবে না। আস্তে আস্তে সব নিঃশেষ হয়ে যাবে। প্রত্যেক সন্তানের উচিত, তাদের বাবা-মায়ের সেবা যত্ন করা। কারণ প্রকৃতির বিচার অত্যন্ত কঠিন। আর পিতার সন্তুষ্টির ওপর আমাদের জীবনে সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তার অবাধ্যতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তাই বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছামতো বান্দার সব গুনাহ মাফ করে দেন, কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার গুনাহ মাফ করেন না; বরং এ গুনাহগারকে পার্থিব জীবনে মৃত্যুর আগেই শাস্তি দিয়ে থাকেন।’
বি.দ্র. একটি লেখায় মা-বাবা দুজনকে কাভার করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। তাই শুধু বাবাকে নিয়েই এই লেখা। বাবার ঋণ পরিশোধ করাতো আদৌ সম্ভব নয়, অন্তত সামান্য দেখভালও কি আমরা সন্তানরা করতে পারব না?
লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
[email protected]
সূত্র : জাগোনিউজ