আলোচনায় কেএনএফ

পাহাড়ে বছরজুড়ে তৎপরতা

NewsDetails_01

তিন পার্বত্য জেলার নয়টি উপজেলা নিয়ে পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে চলতি বছরের মে মাসে পাহাড়ে দুই হাজার সদস্য নিয়ে সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এরই মধ্যে দেশের জঙ্গিদের অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আলোচনায় আসে সংগঠনটি। খবর- বাসু দাশ এর প্রতিবেদন, দৈনিক বাংলা।

কারা এই সশস্ত্র আন্দোলনে
পাহাড়ের বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং এই ছয়টি সম্প্রদায়কে অনগ্রসর ও শান্ত স্বভাবের সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করা হলেও এবার তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। ’৪৭-এর উপমহাদেশের বিভক্তি ও ’৭১-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র আন্দোলনের ফলে পার্বত্য জেলা ছেড়ে ভারতের মিজোরাম, লংতলাই, লুংলেই ও মামিট জেলায় দেশান্তরী হয় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী এসব সম্প্রদায়ের অনেকে। তাদের মধ্য থেকেই কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এখন আর্থিক সহায়তা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই কুকি-চিন রাজ্য প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র আন্দোলনে নেমেছে।

কেএনএফের উদ্দেশ্য
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ড নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় কেএনএফ। এর সশস্ত্র শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) মনে করে, পাহাড়ের নয়টি উপজেলা তাদের পূর্বপুরুষদের আদিম নিবাস। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে দখলদাররা অনুপ্রবেশ করে এবং এই ভূমি দখল করে নেয়। জেএসএসসহ অন্য সংগঠনগুলো তাদের ভূমি ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুমসহ নিরীহ মানুষদের ভীতির মধ্যে রেখেছে। তাই তাদের হাত থেকে মুক্তি পেতে এই সংগঠনের সৃষ্টি।

যেভাবে যাত্রা শুরু
সংগঠনটি ২০১৭ সালে কেএনভি নামে সশস্ত্র সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরবর্তী সময়ে মণিপুর রাজ্যের এবং বার্মার কারেন বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে। একই বছরে সংগঠনটির কয়েক শ সদস্যকে মণিপুর রাজ্যে ও পরে শতাধিক সক্রিয় সদস্যকে কাচিন, কারেন প্রদেশ এবং মণিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণে পাঠায়। ২০১৯ সালে কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষে সশস্ত্র অবস্থায় পার্বত্য জেলায় ফিরে আসে। দেশের রুমা সীমান্ত ও ভারতের মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে একে৪৭সহ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত এ সংগঠনের মোট দুই হাজারের বেশি সদস্য আছে।

যার নেতৃত্বে কেএনএফ
এ সংগঠনের সভাপতি নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। জেএসএসের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কুকি-চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (কেএনডিও) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বম সম্প্রদায় থেকে প্রথমবারের মতো তিনিই ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন।

কেএনএফের জঙ্গিযোগ
সম্প্রতি নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শীর্ষ নেতাদের ধরতে পাহাড়ে অভিযান শুরু হয়। উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় হিজরতের নামে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া দেশের ১৯ জেলার ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব। র‌্যাব জানায়, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে বাড়িছাড়া কিছু তরুণ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আর নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট।’

NewsDetails_03

গত ২০ অক্টোবর রাঙামাটির বিলাইছড়ির সাইজামপাড়া ও বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব এদের বেশ কয়েকজন সদস্যকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। এরপর কেএনএফ সদস্যরা মিজোরাম পালিয়ে গেলেও ডিসেম্বরে আবার ফিরে আসে। র‌্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠনের আমির শামিন মাহফুজের মাধ্যমে ২০২০ সালে কেএনএফের প্রধান নাথান বমের সঙ্গ জঙ্গিদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ২০২১ সালের প্রথম থেকে নব্য জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে নাথান বম তিন বছরের একটি চুক্তি করে। তাদের অর্থের বিনিময়ে কেএনএফ আশ্রয়, খাবার ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।’

ভয়ে দেশান্তরী হচ্ছে বম সম্প্রদায়
গত ১০ অক্টোবর থেকে জেলার রুমা ও রোয়াংছড়ির সীমান্তবর্তী রাঙামাটির বিলাইছড়িতে সন্ত্রাস নির্মূলে অভিযান পরিচালনা করে যৌথবাহিনী। এরই মধ্যে কেএনএফের সঙ্গে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ দ্বন্দ্বের জের ধরে হুমকির মুখে বম সম্প্রদায়ের লোকজন সীমান্তে পাড়ি জমায়। রুমা উপজেলা থেকে ৭০টি পরিবারের তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ভারতের মিজোরাম সীমান্তে পাড়ি জমিয়েছে।

রেমাক্রী প্রাংশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিরা বম জানান, তার ইউনিয়নের ছয়টিরও বেশি পাড়ার তিন শতাধিক বম সম্প্রদায়ের লোক মিজোরাম সীমান্তের দিকে চলে গেছে।

এদিকে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলমান থাকায় গত ১৭ অক্টোবর থেকে বান্দরবানের পাঁচটি উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয় জেলা প্রশাসন। পরে তিনটি উপজেলায় প্রত্যাহার করা হলেও রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। এতে পর্যটনশিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

এ ব্যাপারে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা বলেন, ‘কেএনএফকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। কেএনএফে যারা আছে, তাদের অবশ্যই অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। তাহলেই এ এলাকায় শান্তি ফিরবে।’

এদিকে গত বুধবার দুপুরে কেএনএফ ও ইসলামি জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে ম্রো, লুসাই, খুমি, খেয়াং ও পাংখোয়া জাতিগোষ্ঠীর নাম জড়ানোর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এদিন বান্দরবান শহরের অরুণ সারকী টাউন হলে জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বলেন, সম্প্রতি কেএনএফ পাঁচটি জাতিগোষ্ঠীর নাম ব্যবহার করে কখনো কুকি-চিন রাজ্য, কখনোবা খ্রিষ্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করছে। তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে বান্দরবানে জাতিগত বিভাজন তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সেই সঙ্গে তাদের আস্তানায় ইসলামি জঙ্গিদের আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বান্দরবানের সুনাম নষ্ট করছে। তাই অবিলম্বে কেএনএফের কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানান তারা।

১৯৯৭ সালে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করলেও পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। পার্বত্য জেলায় জেএসএস (মূল), ইউপিডিএফ (মূল), জেএসএস (সংস্কার) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও মগ পার্টি নামে পাঁচটি সংগঠনের সংঘাত ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অশান্ত পাহাড়, সেই সঙ্গে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) আত্মপ্রকাশ ও জঙ্গি সম্পৃক্ততায় ক্রমেই আরও অনিরাপদ হয়ে পড়ছে পাহাড়।

আরও পড়ুন