আলোয় ফিরেছে অন্ধকারের জীবন
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সোলার প্রকল্প
যুগের পর যুগ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্নময়। দুর্গম তাই ছিল না বিদ্যুৎ সুবিধা। বঞ্চিত ছিল নানা সুবিধা থেকে। শিক্ষা থেকে শুরু করে কৃষি, স্বাস্থ্য, দৈনন্দিন জীবনযাপন পড়েছিল মারাত্বক বিপর্যয়ে। ষাটোর্ধ্ব বয়সী মিনু ত্রিপুরা ও ঝিনু ত্রিপুরার দুর্গম জঙ্গলের গহীনে কেটেছে অন্ধকারে। জীবনের শেষ বেলায় এসে আলোর দেখা পেয়ে অনেক খুশি তারা। তাদের মত অনেকের নিয়তির অমোঘ নিয়মের ঘেরাকলে যাপিত জীবনে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সোলার প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গিকার ও নির্দেশনাকে বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে পাহাড়ের উন্নয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুগের পর যুগ বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, ভৌগলিক দুর্গমতার কারণে পৌছাবে কিনা সে প্রশ্ন যখন ধোঁয়াসাচ্ছন্ন; সোলারের বিদ্যুৎই সব উত্তর মিলিয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছোট ছোট গ্রামে বসত করা হাজারো অন্ধকারে যাপিত জীবনে ফিরেছে আলো। সেই আলোয় জ্বলজ্বল করছে দীনমান জীবনে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিনোদন সবখানেই আলোর মেলা। জীবনে যুক্ত হয়েছে সমস্ত পৃথিবী। সবকিছুই এখন নখদর্পনে। আগে যেখানে সন্ধ্যে নামলেই নেমে আসতো সুনসান নিরবতা এখন সেখানে আলোয় আলোয় জীবন উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির খেলা চলছে সর্বত্রই। গতি ফিরেছে অর্থনীতিতে।
সরেজমিনে রাঙামাটি জেলার লংগদু, বিলাইছড়ি এবং রাজস্থলীর দুর্গম গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, যেসব দুর্গম এলাকাগুলো আগামী ২০-৩০ বছরেও জাতীয় গ্রীড লাইনে বিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব নয়, সেসব এলাকায় বিনামূল্যে সৌর বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। আগে সন্ধ্যা নামলেই কাজ সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তো এ অঞ্চলের মানুষরা। বর্তমানে সোলার প্যানেল হোম সিস্টেমে বা সৌর বিদ্যুতের আলোয় বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনমান।
লংগদু উপজেলার বগাচতর ইউপির বাসিন্দা হাসান আলী ও জরিনা বেগম জানান, ভেবেছিলাম জীবনটা অন্ধকারেই কেটে যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সোলার প্যানেল দিয়ে আমাদেরকে জীবনকে আলোতে নিয়ে এসেছে।
রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দা ইউনিয়নের মিতিংগাছড়ির গ্রামের বাসিন্দা শশীবালা ত্রিপুরা ও মিন্টু ত্রিপুরা জানান, সোলার প্যানেল সিস্টেম বা সৌরবিদ্যুৎ পাওয়ায় তাদের গ্রাম আলোকিত হয়েছে। সবাই ফ্যান, বাল্ব এবং টেলিভিশন দেখতে পারছে এবং ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার সুবিধা হচ্ছে।
রাজস্থলী উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউপির চেয়ারম্যান রবার্ট ত্রিপুরা ও বিলাইছড়ি উপজেলার তিনকোনীয় মৌজার হেডম্যান লালএ্যাংলীয়ানা পাংখোয়া জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক দুর্গম গ্রাম রয়েছে, যেখানে কখনও বিদ্যুৎ পৌছানো সম্ভব নয়। সেসব গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত বাসিন্দাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বিনামুল্যে সোলার প্যানেল সিস্টেম দিয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর উদ্যোগ গ্রহন করেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সোলার প্যানেল সিস্টেম প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম গ্রামে সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ ২য় পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি জিওবি অর্থায়নে ২১৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পে ৪০ হাজার পরিবার মাঝে ১০০ মেগাওয়াট সোলার হোম সিস্টেম এবং ২৫০০ পাড়া কেন্দ্র, দুর্গম এলাকার স্টুডেন্ট হোস্টেল, অনাথ আশ্রম কেন্দ্র, এতিমখানাগুলোতে বিতরণ ও স্থাপন করা হচ্ছে ৩২০ মেগাওয়াট কমিউনিটি সিস্টেম। এছাড়া গত অর্থবছরে তিন পার্বত্য জেলায় ১৫,৬০০টি সোলার হোম সিস্টেম বিতরণ এবং স্থাপন করা হয়েছে। এ সিস্টেমের মাধ্যমে একজন গ্রাহক বা উপকারভোগী ৪টি এলআইডি লাইট, সোলার উপযোগী একটি পাকা এবং একটি টেলিভিশনও চালানো সম্ভব। এছাড়াও এ সিস্টেমের মাধ্যমে মোবাইল ফোন চার্জ দেয়ার সুবিধা পাচ্ছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ আজকে যে বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে, তা একমাত্র সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা ও দুরদর্শিতার কারণে। মুজিববর্ষে প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার তিনি যে ঘোষনা দিয়েছিলেন তারই বাস্তবায়ন এটি।
তিনি আরো বলেন, তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষনা ও নির্দেশনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম গ্রামগুলোকে বিদ্যুৎ সেবা পৌছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সোলারের সাহায্যে বিদ্যুৎ ব্যবহারে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর সার্বিক জীবনমানে উন্নতি ঘটছে।