আশার বাতিঘর বান্দরবানের মাতৃমঙ্গল, চাকচিক্যের আড়ালে গলদও কম নয়

মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। নারী স্বাস্থ্যসেবায় আলোকবর্তিকা। ২৪ ঘণ্টার সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিব্ধ প্রতিষ্ঠানটি। অনেকে একে মাতৃঙ্গল নামে জানে। বান্দরবান সদরের মধ্যম পাড়ায় অবস্থিত। সমাজের নিপীড়িত দুস্থ মায়েদের বড় আশ্রয়স্থল মাতৃমঙ্গল। অনেকের কাছে এক আশার বাতিঘর এটি।

প্রতিদিন গর্ভবতী সেবা, প্রসূতি সেবা, ০-৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু স্বাস্থ্য সেবা, কিশোর কিশোরী সেবা, বিনামূল্যে ঔষধ প্রদান, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, সাধারণ রোগীদের কৃমিনাশক ঔষধ, ভিটামিন, আয়রণসহ বিভিন্ন ঔষধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিমাসে ডেলিভারি সেবা (নরমাল) এবং সিজিরিয়ান সেবা দেয়া হচ্ছে।

এ কেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা সালমা ইসলাম নামে এক নারী জানান, গর্ভকালীন চেক আপের জন্য আসছি। এখান থেকে বিনামূল্যে ঔষধ ও চিকিৎসাসেবা ছাড়াও তিনি এখানে কর্মরত চিকিৎসকদের ব্যবহার ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট।

মাতৃমঙ্গলে প্রবেশ করলেই দেখতে পাবেন সব কক্ষগুলো সাদা টাইলস করা। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন । হাসপাতালের কোন দেয়ালে কফ, থুথু কিংবা পানের পিচকারি নেই। প্রসূতি ও নবজাতকদের বেডগুলোও অনেক পরিচ্ছন্ন। ডেলিভারী ওয়ার্ড, অপারেশন থিয়েটার, সাধারণ ওয়ার্ড এবং সিজারিয়ান ওয়ার্ড প্রত্যেকটিই আলাদা কক্ষ। একজন প্রসূতিকে সেবা দেওয়ার সব যন্ত্রপাতি আছে এখানে।

এদিকে সরকারি সেবার মান আরও বাড়াতে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা সম্প্রতী পরিদর্শন করেছেন আশার বাতিঘর নামে পরিচিত মাতৃমঙ্গলে। উদ্বোধন করেছেন ওয়েবক্যাম এবং বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ডিজিটাল উপস্থিতি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা বলেন, সমাজের দুস্থ মানুষগুলো মাতৃমঙ্গলে সেবা নিতে আসেন। সেবা সহজীকরণ, মা ও নবজাতকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভবনে সিসি ক্যামরা স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্ববোধ ত্বরান্বিত করতে ডিজিটাল হাজিরা উদ্বোধন করা হয়েছে। জনগণ এখানে আসলে ভালো সেবা পাবেন। আশা করি সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে এসে নারীরা ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাবেন।

ওই উপস্থিত ছিলেন, জেলা পরিবার পরিকল্পনা উপ-পরিচালক ডা. অংচালু, কনসালটেন্ট ডা. নুরুছাফা, পৌর মেয়র মো. শামসুল ইসলাম।

NewsDetails_03

এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা, ফিল্ড স্টাফ, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের কর্মচারীরা।

তবে এত চাকচিক্যর আড়ালে আছে অনেক বড় গলদ। অভিযোগ আছে হাসপাতালে আসা প্রসূতি মায়েদের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের কর্মচারীরা বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেন জেলার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, মাতৃমঙ্গলে হামিদা বেগম সহ আরো কয়েকজন আছেন। হামিদা বুঝিয়ে এক প্রসূতিকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। পরে সেখানে ট্রিটমেন্ট দেন। ওই দিন কর্তব্যরত চিকিৎসক ওনাকে বারবার ফোন করে হাসপাতালে প্রসূতিকে দিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। এরপরও উনি কোন কর্ণপাত না করে নিজের বাসায় ওই প্রসূতিকে ট্রিটমেন্ট দেন। তার বিনিময়ে সাড়ে চার হাজার টাকা নেন। এছাড়াও ড ম্যা এ নামে একজনকে রোগীদের সাথে খারাপ আচরণ থেকে বিরত থাকার জন্যও বারবার বলা হয়েছে।

বান্দরবান মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার (ক্লিনিক) ডা. কামরুল মনির রিবন জানান, আমি ওনাকে হাসপাতালের রোগী হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য কয়েকবার ফোন করেছিলাম। উনি আনেননি। ওনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ আছে।

তাহলে কি আর বিন্যমূল্যে থাকলো মাতৃমঙ্গলের সেবা ??

মাতৃঙ্গলের প্রসূতিদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন টাকা নেওয়া যাবে না, বিনামূল্যে দিতে হবে সেবা- এরকম সরকারের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এরপরও নানা অজুহাতে হাসপাতালে হামিদার মতো কয়েকজন সরকারের মাতৃমঙ্গলের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে রোগীদের কাছে গুজব ছড়িয়ে বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে পাঠিয়ে দেন। আদায় করেন বেসরকারি ক্লিনিকগুলো থেকে কমিশন।

আয়েশা আক্তার নামে এক প্রসূতির স্বামী অভিযোগ করে বলেন, প্রথমে আমার স্ত্রীকে মাতৃমঙ্গলে নিয়ে আসি। এরপরে এখানের একজন আমার স্ত্রীকে চেকআপ করা লাগবে বলে। পরে একটি বেসরকারি ক্লিনিকের ঠিকানা দেয় এবং সেখানে গিয়ে তার নাম জানাতে বলে । আমি সেখানে গিয়ে তার নাম বলি। ওইখানের চিকিৎসক আমার স্ত্রীর চেক আপ করে বলেন সিজার করাতে হবে দ্রুত। না হলে বড় সমস্যা হবে।

ওই ভুক্তভোগী আরো জানান, ওই বেসরকারি ক্লিনিকে না রেখে আবার মাতৃমঙ্গলে নিয়ে আসি । এবং দুই ঘণ্টা পরে আমার স্ত্রী সুস্থ সন্তান প্রসব করে।

এসব অভিযোগে বিষয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা জানান, বিষয়গুলো আমি আগেও শুনেছি। জড়িতদের বিরুদ্ধে লিখিত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। মাতৃমঙ্গল সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে কোন অর্থ আদায় করার নিয়ম নেই। আর আমি নিজেই গত কয়েকমাসে বান্দরবান সদর হাসপাতাল এবং মাতৃমঙ্গলে কয়েকবার পরিদর্শন করেছি। অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন