একদিকে অনাবৃষ্টি, অন্যদিকে ইঁদুর বন্যার ফলে বান্দরবানে পাহাড়ের জুমক্ষেতে আশানুরুপ ফসল না হওয়া, আর বছরের জন্য পরিবারের খাদ্যের যোগান কিভাবে হবে, সেই আশংখায় জুম চাষিদের কপালে দু:শ্চিন্তার অন্ত নেই।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর বৃষ্টি কম হওয়ার কারনে জেলার রুমা, লামা, থানচিসহ বিভিন্ন উপজেলায় জুম ফলন ভালো হয়নি, অন্যদিকে রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন ও রুমা সদর ইউনিয়নে জুম ক্ষেতে ধানের শীষ আর নেই, ইঁদুরের দল সব খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে। ফলে চলতি বছরের খাদ্যের যোগান কিভাবে আসবে সেই চিন্তাই দিন পার করছে জুমিয়ারা।
রুমা ও থানচি উপজেলা সীমান্ত রেখার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডে রাংদিয়া পাড়া বাসিন্দা বীর বাহাদুর ও অরসেন ত্রিপুরা বলেন, এবার ঈশ্বর সহায় নাহলে পাহাড়ের মানুষের হাহাকার দেখা যাবে, খাদ্য সংকট বা অভাব দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশী।
আরো জানা গেছে, চলতি বছর বাঁশ ঝাড়ে ফুল ও ফল আসার কারনে বেড়েছে ইঁদুরের উপদ্রব। বাঁশের ফুল ও ফল খেয়ে জুম ক্ষেত্রে বিচরণ করা এক একটি ইঁদুরের ওজন হয়ে থাকে প্রায় ১ কেজি। জেলার বিভিন্ন উপজেলার অধিকাংশ এলাকার ইঁদুরের উপদ্রপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতেই ধান, যব ধান, ভুট্টা, তিলসহ অন্যান্য ফসল খেয়ে ফেলায় খাদ্য সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রুমার পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার অংসা প্রু মারমা বলেন, অনাবৃষ্টির পর ইঁদুর বন্যার ফলে পাহাড়ে এবার খাদ্য সংকট দেখা দেবে।
পাহাড়ে উঁচু জমিতে ধান, তিল, ভূট্টা, মরিচ, শাক সবজি, ফল, কুমড়াসহ নানা জাতে ফলন ফলানো হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় পাহাড়ে উঁচু নিচু জমিতে জুম চাষ ঐতিহ্যবাহী চাষ হিসেবে পাহাড়ের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। পাহাড়ে জুম চাষের মাধ্যমে তারা সারা বছরের ধান সংগ্রহ করে রাখেন। কোনও কারণে ভালো ফলন না হলে, ইঁদুরের আক্রমন ঘটলে বা বন্যা দেখা দিলে বছরের খাদ্য মজুদ করা সম্ভব হয় না।
রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মুয়ালপি মারমা পাড়ার জুম চাষি আবু মং মারমা জানান, অনাবৃষ্টির কারণে ধান ভালো হয়নি, তার মধ্যে পাকা জুমে হাজার হাজার ইঁদুর জুমের পাকা ধানসহ ফসল নষ্ট করে ফেলেছে। ইঁদুরের আক্রমনে এ বছর খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে, এমন আশঙ্কা করছি।
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, এসব এলাকার ৯৫ শতাংশ মানুষ জুম চাষে নির্ভরশীল। সুতরাং জুম ধান ভাল না হওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়বে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পরিবার। ইতোপূর্বে ২০১২ সালে বান্দরবানের থানচি, রুমা, রাঙামাটির সাজেক, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি উপজেলায় এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে বান্দরবানের থানচির দুর্গম রেমাক্রি, তিন্দু, ছোট মদক, বড় মদক ও সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট; মূলত এসব এলাকায় খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এসব এলাকায় ত্রিপুরা, ম্রো ও মারমা সম্প্রদায়ের বাস।
জেলার রুমা উপজেলার মুয়ালপি ব্লকে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শাওন চৌধুরী জানান, রুমার প্রাংসাপাড়া, সানাপ্রু পাড়া, ক্যাতুই পাড়া, বাচরাং পাড়া, হ্যাপিহিল পাড়া, আর্তা পাড়া, মুনন্নম পাড়ার ১৮০ পরিবার ইঁদুর বন্যার ফলে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আনুমানিক ৭০ হেক্টর জুম ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ হয়েছে। তবে স্থানীয়দের তথ্য মতে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
সর্বশেষ ২০১২ সালে ইঁদুর বন্যা ও বন্য শুকুরের আক্রমনের কারণে প্রত্যাশা অনুসারে জুম চাষাবাদ না হওয়ায় বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম রেমাক্রী, তিন্দু ও সদর ইউনিয়নের আদিবাসী জুমিয়া পরিবারগুলোতে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
ইঁদুর বন্যায় ক্ষতির কথা স্বীকার করে রুমা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাবাব ফারহান বলেন, আমি মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে ইঁদুর নিধনের জন্য কৃষকদের পরমর্শ দিয়েছি, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা ব্লক সুপারভাইজাররা তৈরি করছে।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় ৮ হাজার ৭৪৭ হেক্টর জমিতে জুমচাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪২৯৭ মেট্রিক টন।
এই ব্যাপারে বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, অনাবৃষ্টি ও ইঁদুরের কারনে এবার জুমচাষে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, গত ২৯ সেপ্টেম্বর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জুম চাষে কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে সেই বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলেছে, আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। সব তথ্য হাতে আসলে পরিষদ থেকে কৃষকদের সহায়তা প্রদান করবে।