এক জিয়াউলে সর্বনাশ আলীকদমের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা !

সরকারিকরণ হওয়া ইউএনডিপির স্কুলের শিক্ষকদের দাপ্তরিক কাজে সহযোগিতাতা করতে এগিয়ে আসেন বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার চম্পট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াউল হক প্রকাশ জিয়াবুল মাস্টার। কিন্তু শিক্ষকদের সহযোগিতার নামে পুরো দমে ঘুষ বাণিজ্যের অধিপতি হিসেবে নিজের আধিপত্য বিস্তার করছেন। সাথে তৈরী করেন একটি সিন্ডিকেট। যারা জিয়াবুল মাষ্টারের নির্ধারিত টাকা দিচ্ছে না,তাদের উপজেলা শিক্ষা অফিসারের যোগসাজশে হাতে ধরে দিচ্ছে কারণ দর্শানোর নোটিশ। বর্তমানে এই জিয়াবুল মাস্টার ‘ইউএনডিপি স্কুল’ এর শিক্ষকদের ‘গলার কাটা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা।

ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জানায়, ঘুষ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট প্রধান চম্পট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াউল হক প্রকাশ জিয়াবুল মাষ্টার। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন কমচঙ ইয়াংছা মাওরুম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিক্সন পাল। মারাং রাইতং পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক থোয়াইক্যনু মার্মা (টাকা ও চেক কালেক্টর), মেনকেউ মেনক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাজিব ম্রো,রাইতুমনি,লাওলিং ন্যাদয় কাম্পুক পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মংহ্লাথুই মারমা (চেক ও টাকা কালেক্টর), লাংড়িং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইকেল মারমা।

অভিযোগ আছে, উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা সবকিছু জেনেও নিরবতা পালন করছেন বরং সিন্ডিকেট প্রধানসহ অন্য সদস্যদের বাঁচাতে উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার ইউএনডিপির সরকারিকরণ হওয়া শিক্ষকদের চেক ও টাকার বিষয়টি স্বীকার না করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। উক্ত মিটিং চলাকালে সকল শিক্ষকদের মোবাইল নিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলেন, প্রায় বিভিন্ন অজুহাতে জিয়াউল হক প্রকাশ জিয়াবুল মাষ্টার শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। জিয়াবুল মাষ্টার যখন যা চাই তা দিতে বলেছেন খোদ উপজেলা শিক্ষা অফিসার এমনটায় অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। এদিকে উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসারের নামে জিয়াউল হক বিভিন্ন শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা দাবির এমন রেকর্ড আর ভিডিও প্রতিবেদকের কাছে সংগ্রহে আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকরা বলেন, জিয়াউল হক বর্তমান কর্মকর্তা আসার পর থেকে অনেক বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এক টেবিল থেকে যে কোন ফাইল আরেক টেবিলে নিতেও টাকা দিতে হয় জিয়াবুল মাষ্টারকে। না দিলে ফাইল আটকে রাখা হয়। বকেয়া বেতন ছাড়ের নামেও টাকা আর চেক দিতে জিয়াবুল মাস্টার আমাদেরকে উৎসাহিত করেছেন।

তারা বলেন,ইউএনডিপির শিক্ষকদের প্রথম বেতন ছাড়ের সময় হিসাব শাখাকে দিতে বলে অধিকাংশ শিক্ষক থেকে ৩-১০ হাজার টাকা আদায় করেন জিয়াউল হক।

তারা আরও বলেন,বর্তমানে সিন্ডিকেট প্রধান জিয়াউলের সাথে উপজেলা শিক্ষা অফিসের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার আশিষ কুমার ধর একাত্ম হয়ে কাজ করছেন। দুর্গম এলাকার শিক্ষকদের দুপুর বারোটা থেকে একটার মধ্যে শিক্ষা অফিসার আশিষ কুমার ধর ফোন দিয়ে বলেন, ‘আজ আপনি স্কুলে যাননি কেন, আমার কাছে রিপোর্ট আছে।’ এর ঘন্টাখানেক পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের জিয়াবুল মাস্টার ফোন করে বলেন, ২০ হাজার টাকা দিলে আমি ‘স্যারকে ম্যানেজ করে ফেলব’, অন্যথায় শোকজ যাবে। এমন একটি রেকর্ড প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

এর আগেও ইউএনপিডির শিক্ষকদের বেতন ছাড়ের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের টাকা দিতে হবে বলে নগদ ১০ হাজার টাকা ও চেক নেওয়া হয়। পরে সেই চেক ও নগদ টাকা সিন্ডিকেট সদস্য মারাং রাইতম লাংথই পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককের থোয়াইক্যনু মারমার কাছে রাখা হয়। এর আগে বিভিন্ন দফায় ২-৫ হাজার টাকা করে আরো প্রায় ৩০ লাখ টাকা জিয়াবুল মাস্টার সিন্ডিকেট আদায় করেছেন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষকরা।

সিন্ডিকেট প্রধান চম্পট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াউল হক জিয়াবুল ও সিন্ডিকেট সদস্য নিক্সনপাল, থোয়াইক্যনু মারমার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ৮০ হাজার টাকার চেক আর স্টাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ায় লিখিত অভিযোগ করেন দুই সহকারী শিক্ষক তামান্ন খানম ও তাসলিমা জাহান।

তারা আরও বলেন, জিয়াউল হক প্রকাশ জিয়াবুল মাষ্টার বিভিন্ন সময় স্যারের (উপজেলা শিক্ষা অফিসারের) কথা বলে টাকা নিয়েছে। কিছু দিন আগেও একটি বিষয়ে টাকা দাবি করলে আমরা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আমাদের বেতন কেমনে উপজেলা শিক্ষা অফিসার করে দেখবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। আমরা কিভাবে চাকরী করি তাও তিনি দেখবেন বলে হুমকি দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদ্যালয়গুলোর ক্ষুদ্র মেরামত, মাইনর মেরামত, রুটিন মেন্টিনেইন্স, ওয়াশব্লক, স্লিপ, বিদ্যালয় আনুষাঙ্গিক বিল, আন্তঃক্রীড়া, ১৫ আগস্টের বরাদ্দ, ভ্রমণ-সহ প্রভৃতির বিল শিক্ষা অফিসার ও হিসাব রক্ষণ অফিস থেকে পাস করানোর নামে সংশ্লিষ্ট ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে ৫শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করেন সিন্ডিকেট প্রধান জিয়াউল মাস্টার।
এর মধ্যে স্লিপের বিল পাসের জন্য প্রতিটি স্কুল থেকে মোটা অংকের টাকা তুলেছে জিয়াউল হক।

তবে মুঠোফোনে জানতে চাইলে সিন্ডিকেট প্রধান ‘চম্পট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াউল হক বলেন’ ‘আমি টাকা ও চেক নিয়েছি কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। আলীকদমের ২শ’-আড়াইশ শিক্ষক আমার গং। আমি তাদের নেতৃত্ব দিই। আমার বিরুদ্ধে যেমন মন চাই তেমন লিখা যাবে সমস্যা নেই।

এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার আশিষ কুমার ধর প্রথমে সবকিছু অস্বীকার করলেও। পরবর্তী জিয়াউলের বিরুদ্ধে দুই শিক্ষক লিখিত অভিযোগের কথা স্বীকার করেন ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।

জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ সফিউল আলম বলেন, ঈদের পর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই ব্যাপারে আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জোবের মোঃ শোয়াইব বলেন, চেক ও টাকা ফেরত দিতে বলেছি। তারা বিষয়টি অস্বীকার করলেও জিয়াউল হকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছে। তদন্ত টিম গঠন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন