ঐতিহাসিকভাবেই পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতে সংক্রমণ হার বেশি

NewsDetails_01

১৮১৭ সালে যশোরে প্রাদুর্ভাব শুরু হয় প্রথম এশিয়াটিক কলেরার। এর আগে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে কলেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও প্রথম এশিয়াটিক কলেরার ইতিহাসটি গুরুত্বপূর্ণ। পরের সাত বছরের মধ্যেই তা তছনছ করে দিয়ে যায় গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল এলাকা। এ মহামারীতে মারা যায় কয়েক লাখ মানুষ। এদের মধ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৈন্য ছিল অনেক। এ কারণেই সে সময়কার ইউরোপীয় বিদগ্ধজনের নজর কাড়তে পেরেছিল রোগটি।

বলা হয়, সে সময় ব্রিটিশ স্থল ও নৌসেনাদের মাধ্যমে রোগটি এতটা বিস্তৃত আকারে ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এবং কোম্পানির বাণিজ্যিক জাহাজও রোগটির বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল।

১৯১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে দেখা গেল গোটা মহাযুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর গুলি-গোলা ও আঘাতে মার্কিন সৈন্য মারা গেছে ৫৩ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর প্রথম ধাক্কাতেই প্রাণহানি হয়েছে ৪৫ হাজার সৈন্যের। মহামারীটির উত্পত্তিস্থল নিয়ে অনেক মত রয়েছে। এর মধ্যে প্রচলিত একটি হলো, এর উত্পত্তি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসের ফোর্ট রাইলিতে। সেখান থেকে তা যুক্তরাষ্ট্রে এবং মহাযুদ্ধে অংশ নিতে পাঠানো সৈন্যদের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্সে রোগটির সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর স্থাপিত একটি ফিল্ড হাসপাতাল। কিন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সৈন্যদের মনোবল ধরে রাখতে সে সময়কার ব্রিটিশ ও মার্কিন গণমাধ্যম এসব খবর চেপে যায়। ফলে স্প্যানিশ ফ্লু নামে এর দায়ভার গিয়ে পড়ে মহাযুদ্ধে নিরপেক্ষ দেশ স্পেনের ঘাড়ে।

ওই মহামারী চলাকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক দূরত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে রোগে আক্রান্ত হয়েছে অসংখ্য পুলিশ কর্মী। অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে, যার সমন্বিত পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়াটা মুশকিল।

এদের মধ্যে দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য ব্যারাক জীবনকেই অনেকাংশে দায়ী করা হয়েছে। ইনফেকশনস ইন কনফাইন্ড স্পেস: ক্রুজ শিপস, মিলিটারি ব্যারাকস অ্যান্ড কলেজ ডরমিটরিজ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, অল্প জায়গার মধ্যে অনেকের একসঙ্গে বসবাস, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া এবং ভাগাভাগি করে টয়লেট সুবিধা ব্যবহারের কারণে ব্যারাকে যেকোনো মহামারীর সংক্রমণ দ্রুত ছড়ায় বেশি। ব্যারাকের পরিবেশ যদি হয় অস্বাস্থ্যকর, তাহলে এ সংক্রমণ আরো গতি পায়। এ গবেষণাপত্রটির লেখক মিশিগানভিত্তিক ডব্লিউএ ফুট হসপিটালের বিশেষজ্ঞ ভিভেক কাক।

এভাবে অতীতে সংঘটিত প্রায় সব মহামারীতেই অদৃশ্য শত্রুর বড় আঘাত পড়েছে সেনাবাহিনী-পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর। চলমান নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দেশে দেশে অদৃশ্য শত্রুর মোকাবেলা করতে গিয়ে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হচ্ছেন পুলিশ-সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। বাংলাদেশেও আক্রান্তদের মধ্যে বড় একটি অংশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্য।

দেশে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণ নিশ্চিত হয়েছে ৬৮ হাজারের বেশি মানুষের। এর মধ্যে ৬ হাজার ৬১২ জনই পুলিশ সদস্য বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছেন ১৯ জন। এর বাইরে পুলিশের আরো ২ হাজার ৭ জন সদস্য করোনার উপসর্গ নিয়ে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি রয়েছেন। এছাড়া আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসে কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন আরো ৬ হাজার ৪৫১ পুলিশ সদস্য।

অন্যদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) তথ্য বলছে, গতকাল পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত মিলিয়ে সর্বমোট ২ হাজার ৫৭ জন কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে কয়েকজন কর্মকর্তাসহ এ পর্যন্ত ১২৮ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯৭ জন।

মহামারীকালে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে এভাবে প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, সংক্রমণ ছড়ানোর উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ভাইরাসজনিত রোগব্যাধি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে যেসব জায়গায় একসঙ্গে অনেক লোক বসবাস করে থাকে, সেসব জায়গার বাসিন্দাদের মধ্যে মহামারী ছড়ায়ও খুব দ্রুত। সে হিসেবে বিভিন্ন ডরমিটরি, মিলিটারি বা পুলিশ ব্যারাক, জেলখানা ও জাহাজ সংক্রমণ ছড়ানোর আদর্শ জায়গা। এসব জায়গায় বসবাসকারীদের মধ্যে বিশেষত পুলিশ ও সৈন্যদের মধ্যে এ কারণে সংক্রামক ব্যাধিও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

NewsDetails_03

এর মধ্যে মিলিটারি ও পুলিশ ব্যারাকগুলোয় কাছাকাছি অবস্থানে একসঙ্গে অনেকে বসবাস করে থাকেন। অবস্থানগত কারণেই তাদের মধ্যে বায়ুবাহিত ও শ্বসনতন্ত্রের রোগ ছড়ায় খুব দ্রুত। ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির ফোর্ট ডিক্সে আকস্মিকভাবে সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জায় ১৩ জন সৈন্যের একসঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণ টেনে ডব্লিউএ ফুট হসপিটালের ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়, পরবর্তী বড় মহামারীটি যদি ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় হয় এবং পর্যাপ্ত ভ্যাকসিনেশনের অভাব থাকে, তাহলে সামরিক ও পুলিশ ব্যারাকগুলোয় বসবাসরতদের মধ্যে বড় ধরনের স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় দেখা দেবে।

এ ভবিষ্যদ্বাণী এরই মধ্যে অনেকটাই প্রমাণিত হয়েছে। এর উদাহরণ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেই। এছাড়া মহামারীকালে সংক্রমণ রোধে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার কারণে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই সংক্রমণ ঝুঁকিতে পড়েন সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে এ ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ের প্রস্তুতিহীনতা। পুলিশ সদস্যরা জানান, সাধারণ সময়ের তুলনায় এখন তাদের বেশি মাত্রায় ডিউটি করতে হচ্ছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তাদের নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধেও কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু সংক্রমণের প্রথম দিকে তেমন প্রস্তুতি না থাকায় বাহিনীতে আক্রান্তের সংখ্যা সে সময় বাড়তে থাকে। পাশাপাশি কোনো প্রকার সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ ছাড়াই আক্রান্তদের কাছে যাওয়ার কারণেও তারাও সংক্রমিত হচ্ছেন।

দেশজুড়ে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলাকালেও দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করেছেন পুলিশ সদস্যরা। সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, বিদেশফেরতদের হাতে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার অমোচনীয় সিল লাগানো এবং পরবর্তী সময়ে তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার কাজ করতে হয়েছে। সে সময় এমনকি এখনো কভিড-১৯ আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির মরদেহ পরিবহন থেকে সত্কারের কাজ করতে হচ্ছে তাদের।

তবে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতে নিয়োগকালীন বাছাইয়ের সময়ে নিয়োগপ্রার্থীর স্বাস্থ্যে গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। সুস্বাস্থ্যের কারণে বাহিনীগুলোর সদস্যদের মধ্যে এমনিতেই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি থাকে বলে বিভিন্ন গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে। বর্তমানে এসব বাহিনীর আক্রান্ত সদস্যদের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠার হারও সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, একক পেশা হিসেবে করোনায় সর্বোচ্চ আক্রান্ত বাংলাদেশ পুলিশ। তেমনি পুলিশে সুস্থ হয়ে ওঠার হারও কিন্তু অনেক বেশি। এ পর্যন্ত প্রায় ৪৮ শতাংশ পুলিশ সদস্য সুস্থ হয়ে পুনরায় দেশের সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন। করোনাকালে যারা যত বেশি জনগণের কাছে গিয়ে সেবা দেবে, তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তত বেশি থাকে। করোনাযুদ্ধের শুরু থেকেই বাংলাদেশ পুলিশের দুই লাখের বেশি সদস্য সর্বতোভাবে মানুষের কাছে গিয়ে সেবা, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ করে চলছেন। এ কারণে পুলিশে সংক্রমণও তুলনামূলকভাবে বেশি হচ্ছে।

পুলিশের মধ্যে সংক্রমণকালীন ঝুঁকি কমাতে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে বহুমুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মহামারীকালীন ডিউটি কাঠামো ও আবাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। করোনার বিষয়ে সচেতন করার পাশাপাশি সদস্যদের সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের জন্য সর্বোত্তম চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিত করতে পুলিশ হাসপাতালগুলোয় উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সংযোজনের পাশাপাশি একটি বেসরকারি হাসপাতাল ভাড়া করা হয়েছে। এসব উদ্যোগে পুলিশে করোনা সংক্রমণের হার ক্রমান্বয়ে কমছে।

মাঠ পর্যায়ে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুর্গম এলাকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া এবং কৃষকদের সহযোগিতার কাজও করছেন তারা। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের সশস্ত্র বাহিনীর অনেক সদস্যই আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন।

আইএসপিআর জানায়, সশস্ত্র বাহিনীর ২ হাজার ৫৭ জনের বাইরেও বাহিনীতে কর্মরতদের পরিবারের সদস্য ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেসামরিক ও অন্যান্য মিলিয়ে মোট ২ হাজার ৭৮৮ জন কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরেছেন ১ হাজার ৪৬১ জন। আর কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৭ জন। এর মধ্যে ১৪ জনই ষাটোর্ধ্ব বয়সের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য। কর্মরত সামরিক ও অসামরিক সদস্য রয়েছেন তিনজন, যাদের প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ধরে অনিরাময়যোগ্য বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আক্রান্ত ১২৮ সদস্যের মধ্যে ৩২ জন এরই মধ্যে সুস্থ হয়ে পুনরায় কাজে যোগদান করেছেন। সংস্থাটির মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন জানান, রূপগঞ্জে একটি স্কুলে করোনায় আক্রান্ত ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের জন্য আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছেড়ে দিতে হয়েছে। নতুন করে পূর্বাঞ্চলে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের কোয়ার্টার প্রস্তুত করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন