খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ ও জেএসএস’র সশস্ত্র তৎপরতায় পাহাড়ি গ্রামে আতংক

NewsDetails_01

খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’ এবং সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতি’র সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি সশস্ত্র তৎপরতায় পাহাড়ি গ্রামগুলোতে চরম আতংক বিরাজ করছে। গেলো সপ্তাহে দীঘিনালা, মহালছড়ি এবং মাটিরাঙায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নির্মমতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৭জন। অগ্নিসংযোগ, লুঠপাট এবং জোর করে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটছে প্রতিদিন কোন না কোন গ্রামে। সমানতালে চলছে অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায়ের অপকর্মও।
সন্ত্রাসী কায়দায় চাঁদা আদায়ের প্রকাশ্য মহড়া চলছে খোদ জেলাশহরে। পরিস্থিতি এতোটা বেগতিক হলেও মুখ খোলার সাহস করছেন কেউই। অনেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক পরিবারের নারীদের জীবনে নেমে এসেছে পৈশাচিক নির্যাতন আর শিশুদের শিক্ষা জীবন যাচ্ছে থমকে। এমনকি গত কয়েকমাসে সংঘটিত বেশ কয়েকটি রোমহর্ষক হত্যাকান্ডের বিষয়ে মামলা হলেও সেগুলোর একটিরও ক্লু উদ্ধার হয়নি।
জানা গেছে, জেএসএস সমর্থন করায় খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, দীঘিনালা, ল²ীছড়ি, মাটিরাঙা, গুইমারা ও রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার অনেক পরিবারকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। একভাবে ইউপিডিএফ সমর্থিত এলাকাগুলোতে পাল্টা প্রতিশোধ নিচ্ছে জেএসএস’র সন্ত্রাসীরা।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বৈসাবি উৎসবের মধ্যে খাগড়াছড়িতে মূল ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এমএন লারমা) অংশের সন্ত্রাসীরা রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। অপহরণ, হামলা, পাল্টা হামলা প্রাণ হারান কমপক্ষে ৭জন। তবে অধিকাংশ লাশ গুম করা হয়েছে। প্রতিপক্ষের হামলা, হুমকি, বাড়ীঘর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জেলার দীঘিনালা, সদর, মহালছড়ি, মাটিরাঙা, রামগড় এবং লক্ষীছড়িতে দুই শতাধিক পরিবারের নারী ও শিশু খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এ সময় সন্ত্রাসীরা নিপীড়ন ও নির্যাতনের পাশাপাশি অর্থ-সম্পদ লুটের অভিযোগ করেছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, বাড়ীঘর ছেড়ে তারা এক কাপড়ে এসেছে। অনেকের লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেছে।
সরেজমিনে ও বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা গেছে, প্রত্যন্ত এলাকায় যেসব পুরুষের সুনির্দিষ্ট পেশা নেই; তাঁদেরকেই টার্গেট করছে সব পক্ষ। নিজেদের দিকে টানতে না পারলে নির্দেশ দিচ্ছে এলাকা ছাড়তে। একই অবস্থার শিকার হচ্ছেন খাগড়াছড়ি শহরের অনেক বাসিন্দাও। বিশেষ করে চাকমা প্রধান অনেক এলাকা এখন রীতিমতো পুরুষশূন্য।
জেএসএস (এম এন লারমা)-এর কেন্দ্রীয় নেতা এবং মহালছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কান্তি চাকমা ঘটনাগুলোকে অমানবিক ও নিন্দনীয় বলে মন্তব্য করে বলেন, আমি নিজেই আতংকিত হতাশ। তিনি আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াই বন্ধ না হলে খাগড়াছড়িতে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অশান্ত রাখতে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েকজন চিহ্নিত জনপ্রতিনিধি নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে ধ্বংসাত্মক খেলায় মেতে উঠেছে। পাহাড়ি জাতিসত্ত্বার ভবিষ্যত ভালো চান, জনগণের অধিকার আন্দোলনকামী এমন অনেকেই সংস্কারপন্থী ‘চার কুচক্রী’র অপকর্মের সাথে নেই।
তিনি উল্টো অভিযোগ করেন, তাঁরা গ্রামে-শহরে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে।
এদিকে জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)-সমর্থকদের বিরুদ্ধে জেলাশহরের মহাজনপাড়া থেকে ইউপিডিএফ সমর্থিত একজন জনপ্রতিনিধিকে বাড়ি ছাড়া নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর প্রতিবাদে মহাজন পাড়ার বাসিন্দারা সংঘটিত হবার চেষ্টা করলে তাতেও বাধা দেয়া হয়। এছাড়া মিলনপুর, মধুপুর, তেঁতুলতলাতেও ইউপিডিএফ ঘরানার লোকজনকে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে।
জেএসএস (এম এন লারমা)-এর কেন্দ্রীয় সহকারি তথ্য ও প্রচার সম্পাদক প্রশান্ত চাকমা তাঁদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগুলো অস্বীকার করে বলেন, তাঁদের (ইউপিডিএফ) পার্টির ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙ্গে গেছে। দলত্যাগীদের সাথে তাঁদের বিরোধ তো থাকবেই। তিনি চলমান পরিস্থিতিতেকে ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর (এম এন লারমা’ মৃত্যুপরবর্তী গৃহযুদ্ধ অবস্থা)-এর সাথে তুলনা করে বলেন, কখন এই অস্থার অবসান হয়; আমরা জানি না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ফাতেমা মেহের ইয়াসমিন জেলায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের আধ্যিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি বাড়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এর ফলে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মাঝে উদ্বেগ আছে। সমস্যার সমাধানে প্রশাসন কাজ করছে।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আলী আহম্মেদ খান জানান, ইনসারজেন্সি এক্টিভিটিগুলো সেনাবাহিনীর এখতিয়ার। সেগুলো তাঁরা দেখছেন। আর স্বাভাবিক অপরাধগুলো লিখিত বা মৌখিকভাবে আসলে আমরা সাধ্যমতো মোকাবেলার চেষ্টা করছি। অপরাধীরা গা ঢাকা দিয়ে থাকলে কিংবা এলাকাবাসী সহযোগিতা না করলে পুলিশের একার পক্ষে আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা কঠিন।

আরও পড়ুন