কতজন যে যাবে তার ইয়ত্তা নেই। ফেইসবুকের গাগু পেইজ এ যেই এড দেখে, সে-ই যেন যাবে। শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছিলো পুরো একটা গ্রামই কি যাচ্ছি নাকি? কিন্তু সব ট্যুরেই যা হয় আরকি, শেষ খেলায় ১২-১৩ জনের টার্গেট থাকে । অবশেষে ১৩ জনকে নিয়েই প্ল্যানটা হলো বান্দবানের বগা লেক (বগাকাইন হ্রদ) হতে জাদিপাই ভ্রমণ।
বন্ধু আর ছোট ভাইদের কাছে বগা লেক-কীর্তণ শুনতে শুনতে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। নাসির ভাই সহ আরও অনেক শুভাকাঙ্খি দিলো আদ্যোপান্ত। সে হিসেবেই গুগল ম্যাপ্স ঘেঁটে প্ল্যানটা সাজালাম । অফিস থেকে ছুটি নিলাম না, কারন ৩ দিন বন্ধ। ১ মে ভোঁর ৬ টায় রওনা। প্ল্যান করে ওয়েবসাইট ঘেঁটে বান্দরবানের এক সপ্তাহের অগ্রিম ওয়েদার আপডেট নিয়ে নিয়েছিলাম। ভারি বর্ষণের কোন সম্ভাবনাই ছিলনা আপডেটের। গুগল আবহাওয়ার অগ্রিম খবর অনুযায়ী প্রতিদিনই বৃষ্টি ও বৃষ্টিঝড় থাকার সম্ভাবনা গড়ে ৩০%। তাপমাত্রার গড় ৩৪ ডিগ্রি (যদিও অনুভূত তাপমাত্রা হবে গড়ে ৪০ ডিগ্রি)। বৃষ্টিময় এই সময় তাই সবাই-ই ট্যুরের ব্যাপারে একটু সন্দিহানও ছিলাম। এছাড়া যেখান থেকে পারলাম বান্দরবানের খুঁটিনাটি মানচিত্র তৈরি করে নিলাম।
ভ্রমন গ্রুপের সবাইকে ১ সপ্তাহ আগ থেকে বিশাল চেক লিস্ট দিয়ে দিলাম – বগা লেক ট্যুরে বড় বোতলে ১লিটার পানি, মাথায় একটা গামছা (গরম থেকে বাচা আর ঘাম মুছার জন্য), মশা ও ক্ষতিকর পোকা তাড়াতে ওডোমোস ক্রিম। সবই ঠিকমতো ছিল, কিন্তু… কিন্তু প্ল্যান ঠিকমতো চললো না: শুরুতেই ছোট ভাই মুন্তাসির এর ১৫ মিনিট দেরিই বলে দিয়েছিল দিনটা কেমন যাবে। সাথে রেড ম্যান খ্যাত ফান্ড ম্যানেজার আরিফ ভাইয়ের ভয় লাগানো ডায়ালগ “ অখানে যারা যায় ফিরে আসে না “। যাইহোক শেষ পর্যন্ত গাগু টিমের উপরওয়ালার নিরবিচ্ছিন্ন রহমত আর গাগুদের দুর্দান্ত গাগুগিরির কারনে সব কিছু তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করে ফিরে আসলাম।
মাত্র ৩ দিনেই ‘বগালেকের অভিযানে গাগুগিরি’ আমাদের হৃদয়ে যে জায়গা করে নিয়েছে তা কখনই মুছে যাওয়ার নয়। বন্ধুদের জন্য বগা লেকের কিছু তথ্য শেয়ার করলাম। বগাকাইন হ্রদ বা বগা হ্রদ বা স্থানীয় নামে বগা লেক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার স্বাদু পানির একটি হ্রদ । বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে বগাকাইন হ্রদের অবস্থান কেওকারাডং পর্বতের গা ঘেষে, রুমা উপজেলায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২,৪০০ ফুট । ফানেল বা চোঙা আকৃতির। আরেকটি ছোট পাহাড়ের চুড়ায় বগা লেকের অদ্ভুত গঠন অনেকটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো। রুমা উপজেলার পূর্ব দিকে শঙ্খ নদীর তীর থেকে ২৯ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি মৌজার নাম ‘নাইতং মৌজা’। এই মৌজার পলিতাই পর্বতশ্রেণীর অন্তর্গত একটি পাহাড়ের চূড়ায় হ্রদটি অবস্থিত । বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিকগণের মতে বগাকাইন হ্রদ মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ কিংবা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আবার ভূমিধ্বসের কারণেও এটি সৃষ্টি হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন। এটিভুবন স্তরসমষ্টির (Bhuban Foundation) নরম শিলা দ্বারা গঠিত। বাংলাপিডিয়ায় এর পানি বেশ অম্লধর্মী এবং একারণে এতে কোনো শ্যাওলা বা অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ নেই, এবং কোনো জলজ প্রাণীও এখানে বাঁচতে পারেনা বলা হলেও ২০০৯-এর তথ্যসূত্রে জানা যায় বগা লেকের পানি অত্যন্ত সুপেয়, এবং লেকের জলে প্রচুর শ্যাওলা, শালুক, শাপলা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ এবং প্রচুর মাছ এমনকি বিশালাকার মাছ রয়েছে।
এই হ্রদটি তিনদিক থেকে পর্বতশৃঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত। এই শৃঙ্গগুলো আবার সর্বোচ্চ ৪৬ মিটার উঁচু বাঁশঝাড়ে আবৃত। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫৭ মিটার ও ৬১০ মিটার উচ্চতার মধ্যবর্তী অবস্থানের একটি মালভূমিতে অবস্থিত। এর গভীরতা হচ্ছে ৩৮ মিটার (১২৫ ফুট)। এটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ হ্রদ— এ থেকে পানি বের হতে পারে না এবং কোনো পানি ঢুকতেও পারে না। এর আশেপাশে পানির কোনো দৃশ্যমান উৎসও নেই। তবে হ্রদ যে উচ্চতায় অবস্থিত তা থেকে ১৫৩ মিটার নিচে একটি ছোট ঝর্ণার উৎস আছে যা বগা ছড়া নামে পরিচিত। হ্রদের পানি কখনও পরিষ্কার আবার কখনওবা ঘোলাটে হয়ে যায়। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন এর তলদেশে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে। এই প্রস্রবণ থেকে পানি বের হওয়ার সময় হ্রদের পানির রঙ বদলে যায়।
স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা এই হ্রদের আশেপাশে দেবতারা বাস করে। এজন্য তারা এখানে পূজা দেন। তবে রহস্যময় উপকথা এবং অকল্পনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বগাকাইন হ্রদকে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেকিং এবং ক্যাম্পিং এলাকায় পরিণত করেছে। বিশেষ করে কিওক্রাডাং যেতে হলে বগাকাইন হ্রদে যাত্রাবিরতি ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ দুর্গম; অত্যন্ত দুর্গম পথে পায়ে হাঁটা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অতি সম্প্রতি (২০১০) রুমা থেকে সরাসরি বগামুখপাড়ায় জীপ (চান্দের গাড়ি বা চাঁদের গাড়ি) চালু হয়েছে। তবে এ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর বুনো জীবনের লোভে ঝিরির পথ নামের আরেকটা পথ ব্যবহার করে থাকেন। হাঁটা পথে ঝিরিপথ ধরে গেলে সময় লাগবে ৫ ঘন্টার মত। এই পথে আপনাকে পাড় হতে হবে অসংখ্য ছোট বড় পাহাড়ি ধিরি। আর শুস্ক মৌসুমে চাঁন্দের গাড়িতে গেলে সময় লাগবে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিটের মত। পথে পরবে অনেক ছোট বড়ো টিলা। কোন কোন সময় চাঁন্দের গাড়ি এতটাই বাঁকা হয়ে উপরে উঠতে থাকে যে, তখন সামনে আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না।
শুস্ক মৌসুমে সাঙ্গু নদীতে পানি না থাকা এক সময় চাঁন্দের গাড়ি সাঙ্গু নদী ও পাড় হবে। যাওয়ার পথে কখনো পড়বে বিশাল পাহাড়ি কলার আর নাম না জানা অনেক ফলের বাগান। বগা লেকের নিচ থেকে ট্রাকিং করে উপরে উঠতে আপনার সময় লাগবে ৪৫ মিনিটের মতন। বগালেকে একটি আর্মি ক্যাম্প রয়েছে। এখানে পৌছানোর পরে ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হয়। বমদের পাশাপাশি বগালেকের ঠিক উল্টো দিকে পাহাড়ের ঢালুতে মুরংদেরও একটি গ্রাম রয়েছে। বগালেক হতে পাহাড়ী ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেলেই মুরংদের এই গ্রামটি পাওয়া যাবে। এরা শিক্ষাগত দিক থেকে বমদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। এখনো পুরোপুরি সভ্য হয়ে সারেনি। তাই তাদের সাথে আচরনে কিংবা ছবি তোলার ক্ষেত্রে সাবধান থাকা ভাল। সকাল, সন্ধ্যা বা রাতে প্রতি বেলায়ই বগা লেক নতুন রূপে ধরা দেয়। এর সৌন্দর্য কাগজে কলমে লিখে আসলে বোঝানো সম্ভব নয়। এক কথায় আপনার কল্পনার বাহিরে। সকালের উজ্জ্বল আলো যেমন বগালেককে দেয় সিগ্ধ সতেজ রূপ। ঠিক তেমনি রাতের বেলায় দেখা যায় ভিন্ন এক মায়াবী হাতছানি। রাতের বগালেক দিনের বগালেক হতে একেবারেই আলাদা। আর যদি রাতটি হয় চাঁদনী রাত তবে এটি হতে পারে আপনার জীবনের সেরা রাতের একটি। কি অসাধারণ সে রূপ। নিকষকালো অন্ধকার রাতে পাহাড়ের বুক চিড়ে হঠাৎ একফালি চাঁদ মৃদু আলোর ঝলক নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বগালেকের শান্তজলে। মৃদুমন্দ বাতাতে ছোট ছোট ঢেউয়ে দুলতে থাকে পানিতে চাঁদের ঝড়ে পাড়া আলোকরাশি। নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলতে হয় এমন রূপে। চারিদিক নিশ্তব্দ, নিথর, জন মানবশুন্য।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে সেই নির্জন বেলায় বগালেকের পাড়ে বসে জোৎনাস্নানের অভিজ্ঞতাই অন্য রকম। মুহুর্তের মাঝেই যেন প্রেম হয়ে যাবে সে প্রকৃতির সাথে। প্রেহরের পর প্রহর চলে যাবে কিন্তু আপনাকে বসে থাকতে হবে অবিচল। এখানে সারা রাতই আর্মিরা পাহাড়া দেয়। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। আপনি চাইলে ক্যাম্পের পিছনে জঙ্গলে বসেও দেখতে পারেন জোৎস্না রাতের রূপ। সেও এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। চারদিকে জঙ্গলের গাছপালা, পাশেই শুকনো ঝর্না, ঝিঝি পোকার ডাক আর উপরে সয়ম্বরা চাঁদ। অসাধারণ সে অনুভূতি।