তিন সম্প্রদায়ের শেষ বিদায়ের একটিই ঠিকানা

কাপ্তাইয়ের রাইখালী

NewsDetails_01

কর্ণফুলির নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত রাঙামাটি জেলার কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা রাইখালী বাজার। আর অন্য পাড়ে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেপিএম এবং তার পাশে খ্রীস্টান হাসপাতাল। বছরের পর বছর ধরে রাইখালী ইউনিয়ন এর কয়েকটি পাড়ার মুসলিম, হিন্দু এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনদেরকে পাশাপাশি সমাধিস্থলে স্বজনরা চিরবিদায় জানিয়ে আসছেন। রাইখালী বাজার, নারানগিরি, লেমুছড়ি এবং কৃষি ফার্ম পাড়ায় এক হাজার এর অধিক পরিবারের বসবাস। এইখানেও আছে সম্প্রিতীর মেলবন্ধন।

মুসলিম, হিন্দু এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন পাশাপাশি বসবাস করে আসছেন যুগের পর যুগ ধরে, যার ফলে সমাধির ক্ষেত্রেও তারা জাত পাতের তোয়াক্কা করেননি। রাইখালী বাজার পার হয়ে পূর্ব দিকে কয়েক ক্রোশ হেঁটে গেলেই দেখা মিলে তিনটি সম্প্রদায়ের সমাধিস্থল। সমাধিস্থল এর সামনে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের সু-উচ্চ চুড়ায় বৌদ্ধ জাদি এবং পাশাপাশি লোকনাথ মন্দির। আবার এর থেকে কয়েকশ গজ দূরে রাইখালী বাজারে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, যেটা রাইখালী ইউনিয়ন এর প্রথম মসজিদ বলে জানান এলাকাবাসী।

এছাড়া রাইখালী বাজারে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ত্রিপুরা সুন্দরী কালি মন্দির এবং মগদেশ্বরী মন্দির। এখানকার বসবাসরত প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে সকল সম্প্রদায়ের লোকজনও অংশ নিয়ে থাকেন। ফলে একই সম্প্রদায়ের না হয়েও একে অপরের আত্মার আত্মীয় হিসাবে বসবাস করে আসছেন যুগের পর যুগ।

এলাকাবাসী জানান, আজ হতে শত বছর পূর্বে তৎকালীন জমিদার রায় সাহেব রাইখালী বাজারের পূর্ব পাশে তিন একর জমি দান করেন তিন সম্প্রদায়ের সমাধির জন্য। তিনি পাশাপাশি তিন সম্প্রদায়ের জন্য সমাধিস্থল নির্মাণ করে দেন। বর্তমানে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অধিকাংশ জায়গা। তবে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন দপ্তর হতে বিভিন্ন সময় এই তিন সম্প্রদায়ের সমাধির জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে, যাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়।

২ নং রাইখালী ইউনিয়ন এর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাইখালী বাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ তালুকদার জানান, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার একটি অসাম্প্রদায়িক সরকার এবং এইখানে তিন সম্প্রদায়ের সমাধিস্থল একই স্থানে হওয়া এটা সাম্প্রতিক সম্প্রিতীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

NewsDetails_03

রাইখালী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কমিটির খতিব মোহাম্মদ আব্দুর রহমান জানান, আমাদের এইখানে পাশাপাশি ৩ সম্প্রদায়ের সমাধি। বছরের পর বছর ধরে আমরা এই এলাকায় সম্প্রিতীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছি।

কাপ্তাই উপজেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রাইখালীর বাসিন্দা দীপক কুমার ভট্টাচার্য জানান, পাশাপাশি তিন সম্প্রদায়ের সমাধি এটি একটি অন্যন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশে। আমাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই।

রাইখালী ত্রিপুরা সুন্দরী কালি মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক টিটু কান্তি দেব জানান, বাংলাদেশের কোন জায়গায় এই রকম পাশাপাশি তিন সম্প্রদায়ের সমাধি আছে কিনা আমাদের জানা নেই, এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁরা সকলে নদী গর্ভ হতে এই সমাধিস্থল গুলোকে রক্ষার জন্য সরকারের নিকট আকুল আবেদন জানান।

৩২১ নং রাইখালী মৌজার হেডম্যান উচিংথোয়াই চৌধুরী বাবলু জানান, এই তিনটি সমাধিস্থল ১শত বছর পূর্বের, এই জায়গা দান করেছেন এই এলাকার তৎকালীন জমিদার থোয়াইপ্রু চৌধুরী (রায় সাহেব), তিনি নারানগিরি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। একজন অসাম্প্রদায়িক, সজ্জন দানশীল ব্যক্তিত্ব হিসাবে তাঁর সুনাম রয়েছে। আমার মৌজায় আমরা সকল সম্প্রদায়ের লোকজন যুগ যুগ ধরে এক সাথে বড় হয়ে আসছি, এইখানে কোন সাম্প্রদায়িকতার জায়গা নেই।

২ নং রাইখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সায়ামং মারমা জানান, এইখানে তিন সম্প্রদায়ের সমাধিস্থল পাশাপাশি অবস্থান করছে। পরস্পরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করছেন প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মানুষ। এক ধর্মের লোকের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অন্য ধর্মের লোকজনও অংশ নিয়ে আসছেন বছরের পর বছর ধরে।

এইখানকার বসবাসরত জনগোষ্ঠীরা তাদের জীবনের শেষ ঠিকানা সমাধিস্থলকে নদী গর্ভ হতে বাঁচানোর জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি অনুরোধ জানান।

আরও পড়ুন