দান করতে গিয়েই দানবীর যখন পথের ফকির

থানচির কাইংয়াং ম্রো’র দিন কাটে মানুষের দয়ায়

NewsDetails_01

দান করা মহৎ কাজ, আর সেই কাজটি করতে গিয়েই তিনি এখন পথের ফকির। একসময় নিজের সহায়, সম্পদ দান করে মানুষ ও সমাজের জন্য দুহাতে বিলিয়ে দিয়েছেন আর সেই ব্যাক্তি এখন চলেন মানুষের দয়া’তে। আমরা বলছি একজন কাইংয়াং ম্রো’র কথা। যার দৃষ্টান্ত এখন খুঁজে পাওয়া দূস্কর। আর এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরী করেছেন পাহাড়বার্তা’র থানচি প্রতিনিধি অনুপম মার্মা।

নাম তার কাইংয়াং ম্রো, বয়স ৯০, বর্তমান ঠিকানা থানচির সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খামলাই ম্রো এর ড্রাগন বাগানের খামারে বসবাস। অনেক আগে ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, বাবা, মাকে হারিয়েছেন। এখন একা থাকেন, কখন মৃত্যু হবে সে গগনা করেই যেন সময় কাটে তার। মৃত বাবা ঙৈকুব ম্রো থানচির ৩৬০ নং কোয়াইক্ষ্যং মৌজার হেডম্যান ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ঙৈকুব ম্রো এর সরল সহজ মনোভাবে দুই ছেলে লেখাপড়া না জানার জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে হেডম্যান পদটি পায়নি। অপর এক ভাই ও অনেক আগেই মারা গেচ্ছেন।

বাবা, মা থাকাকালীন সময় বর্তমান থানচি বাজার (৬০ বছর আগে) মাংছেন ম্রো পাড়া, দেড়শত বছর আগে স্থাপিত হয় মাংছেন ম্রো পাড়া, মাংছেন ম্রো, ঙৈকুব ম্রো ছিলেন আপন ভাই। একজন কারবারী পাড়ার প্রধান, অপরজন হেডম্যান। মৌজার প্রধান তারা মারা যাওয়ার আগেই থানচি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, জামের মসজিদ, থানচি ট্রেড সেন্টার, সোনালী ব্যাংক ভবনসহ দানবীর কাইংয়ং ম্রো এর নামে ১৬ নং হোল্ডিং এর ৫.০০ একর জমি ছিল।

বাবা রেখে যাওয়ার জমিটি ১৯৮৭ সালে ৪.১০ একর জমি স্কুল ও জামে মসজিদ নামে দান করেন। বাকি অংশ ৬০ শতক জমি উপজেলা পরিষদের নামে দান করেন। বাকি ৩০ শতক জমি থানচি ট্রেড সেন্টার এর মরহুম মালিক নজির আহম্মদকে ১০ হাজার টাকা বিনিময়ে বিক্রি করেন তিনি। বর্তমানে ৫.০০ একর জমির মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা।

একান্ত সাক্ষাতকারে পাহাড়বার্তা’কে কাইংয়াং ম্রো বলেন, ৩০ বছর আগে থানচি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রতন কুমার বিশ্বাস, প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাতা অনিল কুমার বিশ্বাস সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, সাবেক ইউপি মেম্বার নুরুল ইসলাম এলাকার ছেলে মেয়েদের মানুষ করার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার করার জন্য দুই একর জায়গা চেয়েছিল। আমরা দুই ভাই মিলে সেই জায়গা দান করেছিলাম। এর ১০/১২ বছর পর বর্তমান প্রধান শিক্ষক নূর মোহাম্মদ দানকৃত জমিটি নাম জারীর জন্য চাইলে হয়ে গেল ৪.১০ একর জায়গা। আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ম্যাজিস্ট্রেট নিকট দাবী করছিলাম, স্কুল সীমানায় আম, কাঠাল, তেঁতুলগাছ গুলি আমার অনুমতি ছাড়া কাটতে পারবেনা। স্কুলের সামনে দুইটি দোকান প্লটের জায়গার পরিমান আমার জন্য রাখতে হবে। অন্যজনকে জায়গা ভাড়া দিয়ে সে দোকান করে, ভাড়া টাকা আমাকে দিতে হবে।

NewsDetails_03

স্কুলে কক্ষে সকলের সামনে আমার একটি বড় ফ্রেমের ছবি টাংগিয়ে রাখতে হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সব দাবী মেনে নিলে, তিনি নাম জারীর কাগজের স্বাক্ষর টিপ দেন। নাম জারীর ১০/১২ বছর পর ২০১২ সালে ১৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী থানচি পা রাখলে স্কুলটি সরকারী করনের ঘোষনা দেন। আমাকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দোকান ভাড়া হিসেবে মাসিক ২/৩ হাজার টাকা দিত, কিন্তু এখন কোন টাকা দিচ্ছেন না। আমার এখন ভিক্ষা করে খেতে হচ্ছে।

তিনি দাবী করে বলেন, আমার বাবা’র রোপিত দেড়শত বছরের তেঁতুল গাছটিও কেটে ফেলে বিক্রি করে দিয়েছে প্রধান শিক্ষক, আমাকে জানালো না।

তিনি আর ও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে রুমা, থানচি হয়ে আসছিল। এছাড়াও বাজালিয়া বোমাংহাট হতেও আসছিল ভারতে যাওয়ার জন্য, তখন তিনি ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে তিনি তাদের রশদ, খাদ্য, কাপড় চোপড় ধুইয়ে দিত এছাড়া ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র দিনের বেলা গোপনে জঙ্গলে রেখে দিতাম, রাত হলে তাদের এনে দিতাম। দিনের বেলা আমাদের পাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের রাস্তা দেখায় দিতাম এ ছিল আমার কাজ। আমি শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শবাদী তারই আদর্শ লালন পালন করি।

এই ব্যাপারে থানচি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর মোহাম্মদ পাহাড়বার্তা’কে বলেন, স্কুলের মেরামত কাজের কারনে তার ছবি এক জায়গা রাখছি। আমার রুমে টাঙ্গানো সম্ভব নয়।

তিনি আরো বলেন, স্কুলকে ৪.১৯ একর দিয়েছিল দান করে, তখন খরচ বাবদ ২০ হাজার টাকা দরে ১৫ হাজার টাকা মোট ৩৫ হাজার টাকা নগদ দিয়েছিলাম। ঐ টাকা দিয়ে তিনি নাম জারীর জন্য কোর্টে গিয়েছিল। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে দোকান ভাড়া বাবদ অনেক বছর চালাইছি। গতকালও ৫০০ টাকা দিয়েছি। তেঁতুল গাছ কাটতে আদেশ দিয়েছিল উপজেলা চেয়ারম্যান, আমি সম্মতি দিয়েছিলাম তাই কেটেছে। স্কুলের নামে চার দশমিক দশ একর দান করলেও আড়াই একর পেয়েছি। বাকি জায়গা মসজিদ, রাস্তা পড়ে যাওযায় তার জন্য কিছু করতে পারিনি। সরকারী হয়ে যাওয়া দোকান ভাড়া দেয়ার নিষেধ রয়েছে।

তবে স্থানীয়রা মনে করছে, থানচির প্রশাসনের উচিত অন্তত সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় একটি বাড়ি প্রদান ও সরকারী ভাতার ব্যবস্থা করে দিলে অন্তত জীবনের শেষ সময়টা একটু শান্তিতে দিন পার করতে পারবে এক সময়ের দূর্গম জনপদ থানচির এই দানবীরের বাকিটা সময়।

আরও পড়ুন