খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সরকারি পরিত্যক্ত ভবন নিলামে বিক্রির অনিয়মের অনুসন্ধানে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে নিলামের কোন ডাকই হয়নি। নিলাম ডাকে অংশগ্রহণকারী যে ৩ জনের নাম দেখানো হয়েছে তাদের ২ জন ঐদিন উপস্থিতই ছিলেননা। সর্বোচ্চ দরদাতা দেখিয়ে যার নামে ভবনগুলো দেওয়া হয়েছে নিলাম ডাকের দিন তিনি ব্যক্তিগত কাজে চট্টগ্রাম অবস্থান করছিলেন।
গত ১৬ জুন পাহাড় বার্তায় “দীঘিনালায় নিলামের টাকা আত্মসাৎ” শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে উপজেলার সর্বত্র আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। অপরদিকে কথিত নিলাম ডাকের বৈধতা প্রকাশ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে নতুন কৌশল। সে অনুযায়ী দেখানো হচ্ছে গত ৪ জানুয়ারি নিলাম ডাক অনুষ্ঠিত হয়। যে নিলামে অংশগ্রহণকারী ছিলেন তিনজন। এরমধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা বোয়ালখালী কামাকুছড়া এলাকার রাজ্যময় চাকমা। ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকায় ২য় দরদাতা কবাখালী মুসলিম পাড়ার নুর হোসেন এবং ১লাখ ৩৩ হাজার টাকায় ৩য় দরদাতা ছিলেন দীঘিনালা থানাপাড়ার বিল্লাল হোসেন।
প্রকৃতপক্ষে ভবনগুলো সাড়ে ৩ লাখ টাকায় আলোচনার মাধ্যমে ক্রয় করেন কাগজে দেখানো ৩য় দরদাতা বিল্লাল হোসেন। অথচ নিলাম ডাকের কাগজপত্রে ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকায় বিল্লাল হোসেনকে দেখানো হয়েছে ৩য় দরদাতা।
বিল্লাল হোসেন জানান, এ ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়াটি হয়েছে জনৈক ব্যক্তির বাসায় বসে নুর হোসেনের (কাগজে দেখানো ২য় দরদাতা) সাথে আলোচনার ভিত্তিতে।
বিল্লাল হোসেন আরও জানান, নিলাম ডাক বলতে কোন কিছুই হয়নি, তিনি নিজেও কোন নিলাম ডাকে অংশগ্রহণ করেননি এমনকি কোন কাগজপত্রে স্বাক্ষরও দেননি। উল্টো প্রশ্ন রেখে বিল্লাল বলেন, “আমি সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারলে নিলাম ডাকে উপস্থিত থাকলে কি আর ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ডেকে ৩য় দরদাতা হতাম? আর ঐ জিনিস কি পরে দুই লাখ টাকা দিয়ে কিনে নিতাম?”
এছাড়া সর্বোচ্চ দরদাতা রাজ্যময় চাকমাও বলছেন একই ধরনের কথা। রাজ্যময় চাকমা জানান, নিলাম ডাকের যে তারিখ বলা হচ্ছে এ সময় তিনি ব্যক্তিগত কাজে চট্টগ্রাম অবস্থান করছিলেন।এছাড়া নিলাম ডাকের কাগজপত্রে রাজ্যময় চাকমার নামের পাশে যে মোবাইল নাম্বারটি দেওয়া আছে সেটা তার নয় বলেও দাবী করেন রাজ্যময়।
ভবন আপনার নামে কিভাবে দেওয়া হলো এমন প্রশ্নের জবাবে রাজ্যময় চাকমা জানান, এটি একটি লাভের কাজ। কাজটিতে জড়িত থাকলে লাভ হবে একথা তাকে জানানো হয়েছিল। তিনি রাজি হলে আলোচনার মাধ্যমেই লোক দেখানো প্রক্রিয়াটি কাগজে কলমে সম্পন্ন করা হয়। একপর্যায়ে রাজ্যময় অকপটে স্বীকার করে বলেন,”মূলতঃ এটি নিকুইজিশন,তবে ১ জনের ভাগে কত টাকা লাভ পাবো সেটা পার্টনারদের সাথে হিসেবের পর বলা যাবে।”
অপরদিকে নিলামের কাগজপত্রে রাজ্যময় চাকমার নামের পাশে থাকা মোবাইল নাম্বারে ফোন দিলে রিসিভ করেন নিলামের ২য় দরদাতা হিসেবে উল্লেখ করা নুর হোসেন। যিনি পেশায় একজন ঠিকাদার এবং সংবাদকর্মী হিসেবেও পরিচিত। ফোন রিসিভ করার পর বিষয়টি বুঝতে পেরে কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর তার ব্যবহৃত অন্য নাম্বারে ফোন দিলেও আর রিসিভ করেননি।
দীঘিনালা উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ মোস্তফা কামাল মিন্টু জানান, উপজেলা পরিষদের কোন ভবন নিলামে বিক্রি বা কোন নিলাম ডাকের কিছুই শোনেননি। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর তিনি জেনেছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আবদুস সালাম জানান, নিলাম ডাকের বিষয়ে এবং নিলাম ডাকের কোন কাগজপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেছেন কিনা এসবের কিছুই তার মনে নেই।
এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী অরুণ কুমার দাশ জানান, নিলাম প্রক্রিয়াটি নিয়মের মধ্যে হয়নি।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আরাফাতুল আলমের সরকারি মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, এ বিষয়ে তিনি অবগত নন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলে তিনি বিষয়টি দেখবেন।
প্রসঙ্গতঃ দীঘিনালা মডেল মসজিদ নির্মাণ করতে গত ৪ জানুয়ারি উপজেলা পরিষদের পুরাতন কমিউনিটি সেন্টার, পুরাতন উপজেলা পরিষদ ও পুরাতন শিক্ষা অফিসের টিনসেড ভবন (সর্বশেষ কৃষি ব্যাংক হিসাবে ব্যবহৃত) বিক্রি করতে নাটকীয় এক নিলাম সাজানো হয়। সাড়ে ৩ লাখ টাকায় ভবন বিক্রয় করা হলেও সাজানো নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতার ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেখিয়ে কোষাগারে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা জমা করা হয়। অথচ স্থানীয়দের ধারণা প্রকাশ্যে নিলাম ডাকা হলে ভবনগুলোর দাম আরও বেশি পাওয়া যেতো।