এখন শীতকাল। চারিদিকে কুয়াশা । ঠান্ডা বাতাস বইছে। শীতের প্রকোপে আড়মোরা বাঁধেন বৃদ্ধ-বাল-বনিতারা। সকাল কিংবা সন্ধ্যা হলেই পাহাড়ের চারপাশের গ্রামগুলো সাদা কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে চারিদিক। ঠান্ডার ভয়ে অনেকে বাসা থেকে বাহির হতে চান না। কিন্তু সকাল হলেই জীবিকার প্রয়োজনে শীতের আড়মোড়া ভেঙে বাহির হতে হয়ে রুটি রোজগারের সন্ধানে। তেমনই একজন মোহাম্মদ আলী, থাকেন লামা পৌরসভার সাবেক বিলছড়ি এলাকায়। লামা রুপসীপাড়া সড়কের মোটর সাইকেল চালক সমিতির সভাপতিও তিনি। সংসারের অভাবের তাড়নায় লেখা পড়ায় তেমন এগোতে পারেননি, পঞ্চম শ্রেণী থেকে ছিটকে পড়েন। তাই অল্প বয়সে হাল ধরতে হয় পরিবারের। আগে দর্জির দোকান ছিল। সেই আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেত হত। এখন তিনি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান। আয়ও ভালো। দিনে আয় করেন ৮০০ টাকা কখনও ১২০০-১৪০০ টাকা। সংসারের সবার চাহিদা মিটিয়ে সঞ্চয়ও করেন তিনি। দূর্গম এলাকায় একমাত্র যানবাহন মোটরবাইক। কোন ছোট কিংবা বড় গাড়ি ওইখানে যেতে পারে না । তাই দূর্গমতাকে পুঁজি করে মোটরবাইক চালানোকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন তিনি ।
শুধু মোহাম্মদ আলীই নন, মোটর সাইকেল চালানোকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন সরই ইউনিয়নের ক্যায়াজুপাড়া এলাকার মোটর সাইকেল চালক শফিকুল ইসলাম ও শেখ মোহাম্মদ। তারা জানান, অভাবের কারণে লেখাপড়া থেকে আগেই ছিটকে পড়ে চায়ের দোকান করতেন। এতে সংসার চালাতে কষ্ট হত। বিকল্প কর্মসংস্থান না হওয়ায় এখন মোটরসাইকেলে যাত্রী বহনকেই তারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এখন ভালো আয় হয় ।
এভাবে উপজেলার প্রায় ৯শ বেকার কর্মসংস্থান হিসেবে নিয়েছেন মোটরসাইকেল চালনাকে। শুধু যুবক নয় কিশোর ও প্রাপ্ত বয়স্করাও আছেন এই পেশায়। ভাড়া একটু বেশি হলেও কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে যাত্রীরা বিকল্প যান হিসেবে এই মোটবাইকে চড়তে স্বাচ্ছন্দ করেন। দিন কিংবা রাত যে কোন সময়ে সাড়া দেন তারা।
দুর্গম পাহাড়ি যেসব এলাকায় গাড়ি যেতে পারেনা, সেসব এলাকায়ও জরুরী প্রয়োজনে যাতায়াত করতে পারছেন স্থানীয় অধিবাসীরা।
মোটর সাইকেলে সেবা নেওয়া যাত্রী মো. ফরিদ উদ্দিন, রিয়াজ, পিন্টুসহ অনেকে জানায়, পাাহাড়ি রাস্তা দিয়ে অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এ কারণে তারা নিরুপায় হয়েই ভাড়ার মোটরসাইকেলে যাতায়াত করতে হয়। রাত-বিরাতে তাদেরকে ফোন করলেই পাওয়া যায়।
তারা আরো জানায়, এসব রাস্তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্গম। অনেক সময় কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে চিকিৎসার প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে নিতে চাইলে নানা রকম ভোগান্তির কবলে পড়তে হয়। তখন ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল ভোগান্তি অবসান ঘটায়। তারা বলেন, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যেত।
এরই মধ্যে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড ভিত্তিক সমিতিও গঠন করেছেন চালকরা। চালকদের মাঝে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিভিন্ন সড়ক ভিত্তিক রাখা হয়েছে লাইনম্যানও।
লামা বাজার মিশনঘাট, পূর্বপাড়া, মেরাখোলা সড়কের মোটরসাইকেল সমিতির সভাপতি ফরহাদ হোসেন বলেন, উপজেলা ও পৌরসভা ভিত্তিক বিভিন্ন স্থানে মোটরসাইকেল স্ট্যান্ড আছে। যার মধ্যে উপজেলা সদর কেন্দ্রীক চেয়ারম্যান পাড়া মিম ফিলিং স্টেশন, আলী মিয়া শপিং কমপ্লেক্স ও হোটেল সী হিল সংলগ্নে রয়েছে ৩টি স্ট্যান্ড। এখান থেকে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভাড়ায় যাত্রী বহন করেন।
তিনি আরো জানান, মানুষ হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা বিনামূল্যে মানবসেবায় এগিয়ে আসি। কোন গরীব ব্যক্তি দুর্ঘটনায় পতিত হলে, কোন গরীব মানুষ অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না, কোন শিক্ষার্থী অর্থাভাবে বই কিনতে পারছেনা কিংবা কোন গরীব অভিভাবক তার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছে না; এমন মানুষকে আমরা আর্থিক সহায়তা করে থাকি।
সরই মোটর সাইকেল চালক সমিতির সভাপতি আবদুল জব্বার বলেন, ‘আমি কাজের অনেক সন্ধান করেছি, পাইনি। এখন সংসার চালাতে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাচ্ছি। প্রতিদিন গড়ে ১৩০০ টাকা আয় হয়। সব খরচ বাদে ৮০০ টাকা থাকে। এতে সংসার চলে যাচ্ছে।
পাহাড়ের দূর্গম এলাকাগুলোতে যাত্রী পরিবহনে এখন সহজ মাধ্যম এই মোটরসাইকেল। ভাড়া একটু বেশি হলেও খুব কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে বিধায় যাত্রীদের কাছে দিনে দিনে বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা। তবে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালকদের প্রয়োজন প্রশিক্ষণ ।
এ বিষয়ে লামা পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, বেকার না থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে যারা মোটরসাইকেল চালান তাদের পরিচয়পত্র, প্রশিক্ষণ ও নির্দিষ্ট পোষাক থাকা প্রয়োজন।
এছাড়াও লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, পাহাড়ি এলাকায় জরুরী প্রয়োজনে ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেলের বিকল্প নেই। পাশাপাশি এ পেশায় বেকারত্বও রোধ হচ্ছে। সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল চালকদেরকে দুই দিনের ট্রাফিক নিয়ম কানুন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।