নানা রঙ্গের ফানুস বাতির ঝলকানিতে রঙ্গিন লামার আকাশ

NewsDetails_01

পাহাড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মার্মা সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব “ওয়াগ্যোয়েই পোয়েঃ”। চার মাস ধর্মীয় কর্ম ‘বর্ষাবাস’ শেষে এ উৎসব পালন করেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি মার্মা ও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ; নানা রঙ্গের ফানুস বাতির ঝলকানিতে রঙ্গিন হয়ে উঠে রাতের আকাশ। মূলত এ উৎসব বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিনয়ধর্ম এবং আত্মসমর্পন ও আত্মশুদ্ধির অনুষ্ঠান। দুইদিন ব্যাপী এ উৎসবকে ঘিরে এখন বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় চলছে আনন্দের বন্যা ও সাজ সাজ রব।

এদিকে যথাযথ মর্যাদায় উৎসব পালনের জন্য ইতিমধ্যে উপজেলার ৭৬টি বৌদ্ধ বিহারে অনুদান প্রদান করা হয়েছে বলে জানান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা জামাল ও পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ফাতেমা পারুল। এছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৌদ্ধ বিহারগুলোতে নেয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা। প্রথম দিন ফানুস উড়ানো, রাতে পিঠা তৈরি এবং শেষ দিন রথ টেনে বিহারগুলো প্রদক্ষিণ শেষে নদীতে বির্সজনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।

জানা যায়, ওয়াগ্যোয়েই পোয়েঃ মার্মা শব্দ, এর অর্থ উপবাসের সমাপ্তি। অন্য অধিবাসীরা একে “ওয়াহ” (প্রবারণা পূর্ণিমা) বলে থাকে। বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা আষাঢী পূনির্মা থেকে আশ্বিনী পূর্নিমা পর্যন্ত তিন মাস বর্ষব্রত অর্থাৎ উপবাস পালন করেন। এরপর ধর্মীয় গুরুদের সম্মানে বিশেষ উৎসবের আয়োজন করে। এ উৎসবই হলো ‘ওয়াইগ্যোয়েই পোয়েঃ’ উৎসব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে এখন উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন বাজারগুলোতে পাহাড়ি তরুণ তরুনীদের মাঝে কেনাকাটার ধুম পড়েছে। শিশু কিশোর ও তরুণ তরুনীরা নতুন পোষাক পরিধান করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বন্ধুদের সাথে। উপজেলার সবচেয়ে জমজমাট উৎসব আয়োজন করা হয়- পৌর শহরের কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহার, রাজবাড়ী, সাবেক বিলছড়ি বৌদ্ধ বিহার, ছাগল খাইয়া, শীলেরতুয়া, গজালিয়া ইউনিয়নের হেডম্যান পাড়া, রুপসীপাড়া ইউনিয়নের চাহ্লাখইন হেডম্যান পাড়া, ফাইতং ইউনিয়নের হেডম্যান পাড়া ও ইয়াংছা বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গনে।

এ উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ছাড়াও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোতেও চলছে বিভিন্ন আয়োজন। উৎসবের প্রথম দিন বুধবার বিকাল থেকে শুরু হয় ফানুস উড়ানোর মহোৎসব। এই ফানুস চীনা কাগজ দিয়ে তৈরি করা হয়, পরে সলতে দিয়ে তৈল সহকারে তা উড়ানো হয়। এতে বিভিন্ন রং, বর্ণ এবং সাইজের ফানুস তৈরি হয়। এ সময় সূত্রপাত ও কীর্তন হয়, যুবকেরা নৃত্য করে। ফানুস উড়ানোর দিকটা ধর্মীয়। শাস্ত্রে আছে দেবরাজ ইন্দ্র পবিত্র চুল রাশি সংগ্রহ করে আকাশ চুলামণি চৈত্য নির্মাণ করে দেন। সে চুলামণি চৈত্যকে বন্দনার জন্যই ফানুস উড়ানো হয়। ফানুস বাতি উড়ানোর প্রতিযোগিতা সকলকে আকৃষ্ট করে। বিশাল আকৃতির ফানুস বাতি আকাশে উড়ানোর দৃশ্য দেখার জন্য বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের লোক এমনকি বহু বিদেশি পর্যটকও ভীড় জমায়। এর পাশাপাশি রথে জ্বালানো হয় হাজার হাজার মোমবাতি। এ জন্য স্থানীয় বৌদ্ধ বিহারগুলোকে সাজানো হয়েছে বর্নিল সাজে।

NewsDetails_03

আজ বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উপজেলার প্রতিটি বৌদ্ধ বিহার ও পাড়ায় পাড়ায় বর্ণাঢ্য কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে মার্মা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ছোয়াইং দান, বিশেষ প্রার্থণা, তরুন তরুনীদের বর্ণাঢ্য রথ যাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। ওয়াগ্যোয়েই পোয়েঃ বা প্রবারণা পুর্ণিমা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও এটি একটি সামাজিক ও আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়। মারমাদের পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মালম্বী বড়ুয়া, চাকমা, তঞ্চঙ্গারাও এ উৎসবে যোগ দেয়। এ সময় অন্য এক আমেজ সৃষ্টি হয় এ পাহাড়ি উপজেলায়।

লামা পৌরসভা এলাকার বড়নুনারবিল পাড়ার সো সো ওয়ান বলেন, ওয়াগ্যোই পোয়ে আমাদের খুবই আকর্ষণীয় একটি উৎসব। এ উৎসবে আমরা ফানুস উড়াবো, তাই অনেক আগে থেকে বন্ধু-বান্ধবীরা মিলে ফানুস বানিয়েছি।

ছোটনুনারবিল পাড়ার বাসিন্দা মংছিং মার্মা ও বাবু মং মার্মা এক সূরে বলেন, প্রবারণার সময় রথ টানবো, পিঠা বানাবো, বন্ধুরা মিলে ফানুস উড়াবো। খুব মজা হবে। তাই বন্ধুরা মিলে অনেকগুলো ফানুস বানিয়েছি।

এ বিষয়ে লামা কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারের ওয়াহ উদযাপন কমিটির সভাপতি চাহ্লাছিং মার্মা জানায়, প্রতি বছরের মত এবারও আমরা ওয়াগ্যোই পোয়ে বা প্রবারণা পূর্ণিমার আয়োজন করেছি। প্রত্যেক বার ৩ দিন ৪ দিন অনুষ্ঠান করলেও এবার আমরা ২ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে। প্রথম দিন ফানুস উড়ানো, রাতে পিঠা তৈরি এবং শেষ দিন রথ টেনে মন্দিরগুলো প্রদক্ষিণ শেষে নদীতে বির্সজনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।

আরও পড়ুন