নিরাপদ সড়ক : স্বপ্ন ও বাস্তবতা
দুর্ঘটনা (Acccident) শব্দটা শুনলেই চমকে উঠি। বুক ধড়ফড় করে। মাথা ঘুরে। চোখ ঝাপসা হয়। একটি দুর্ঘটনা মানে সারা জীবনের কান্না। উইকিপিডিয়াতে দুর্ঘটনাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, “Accident is unintended, normally unwanted event that was not directly caused by humans. The term accident implies that nobody should be blamed but the event may have been caused by unrecognized or unaddressed risks.” যার সহজ বাংলা অর্থ “একটি দুর্ঘটনা হলো অনিচ্ছাকৃত, সাধারণত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যা সরাসরি মানুষের দ্বারা ঘটেনা। কাউকে দোষারোপ করা উচিত নহে-দুর্ঘটনা শব্দ দ্বারা এ জাতীয় অর্থ বুঝায়। তবে ঘটনাটি অচেনা বা অপ্রকাশিত ঝুঁকির কারণে হতে পারে।“
দুর্ঘটনার এ সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় পাইঃ ১। দুর্ঘটনা হলো অনিচ্ছাকৃত বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ২। এটি সরসরি মানুষের দ্বারা ঘটেনা ৩। কাউকে দোষারোপ করা উচিত নয় ৪। অচেনা বা অপ্রত্যাশিত ঝুঁকির কারণে দুর্ঘটনা হয়। বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনাকে এ সংজ্ঞার সাথে মেলালে সড়ক দুর্ঘটনা বলা যাবে কী-না সড়ক বিশেষজ্ঞগণ ভালো বলতে পারবেন। একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবে বলবো-বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কারো অজানা নয়, কম-বেশি সবার জানা।তা সত্ত্বে ও দুর্ঘটনা ঘটছে। আইন মানছে না কেউ। যা হচ্ছে বা যা ঘটছে তা ইচ্ছাকৃত। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সড়ক দুর্ঘটনা না বলে সড়কে মানুষ হত্যা, গাড়ির নীচে বিপন্ন মানুষের জীবন বলাই শ্রেয়।
কিশোরগঞ্জ জেলায় চাকুরিকালীন আমার পাশের রুমে একজন সিনিয়র সহকারী জজ থাকতেন। তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হতো। একদিন কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমরা জজ সাহেবেরা যতটুকু না ক্ষমতাবান, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান সড়ক ও মহাসড়কের একজন ড্রাইভার। তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন যে, একজন সহকারী বা সিনিয়র সহকারী জজ বা জেলা জজ কোন মামলার রায় দিলে তার উপরে অনেক আপিল আদালত আছে। একজন আসামীকে ফাঁসির কাষ্ট পর্যন্ত নিয়ে যেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।কিন্তু একজন ড্রাইভার নিজে বেঁচে গিয়ে মূহুর্তেই শত শত পাবলিককে পিষিয়ে দিতে পারে। পলাতক অবস্থা থেকে ধৃত হলে ইচ্ছাকৃত ঘটনা না অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা এই বিতর্কে মামলা ধরাশায়ী হয়ে ডিপ ফ্রিজে চলে যায়।
সড়ক দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনার সংজ্ঞার মোড়কে আবৃত করতে চাই না। এটা যদি করা হয় প্রকৃত সত্য ধামাচাপা পড়বে। অকাতরে নিরীহ মানুষের প্রাণ ঝড়বে। শুধু আমি একা নই। আমার সাথে অনেক জাগ্রত বিবেক ও একমত। দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকা (১৬ আগস্ট, ২০২১) এর সম্পাদকীয়তে ঠিক এভাবে লেখা হয়েছে-“ গণপরিবহণের গায়ে নানা জনসচেতনতামূলক বাণী দেখা যায়, যেমন-সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি, একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না প্রভৃতি। কিন্তু বাস্তবে কি চালকেরা এসবের তোয়াক্কা করে? তাদের কাছে যাত্রীর জীবনের কি কোন মূল্য আছে? আবার বেপরোয়া চালকদের রশি টানার দায়িত্ব যাদের তারা ও কী অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে? যদি দায়িত্বপালন করে থাকে তাহলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হচ্ছে না কেন?
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারেই কম নয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ (বিশ্বব্যাংক)। দেশে প্রতি হাজার লোকের বিপরীতে যানবাহন আছে মাত্র ১৮ জনের। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান একটু দেখা যাক। তাতে দেখা যায়, সড়ক পথে ৪ হাজার ৮৯১ টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এতে আহত হয় ৮৬০০ জন, নিহত হয় ৬৬৮৬ জন। বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ১৮ জন লোক মারা যায়। করোনা ভাইরাস নিয়ে সকলে যেভাবে আতংকিত, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সেরকম আতংকিত কেউ নয়।
কারা দায়ী? সংক্ষেপে বলা যায় ৯০% সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ড্রাইভারগণ (BARI,2020)। কি কারণে দায়ী? বেপরোয়া গতির কারণেই অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা (৪৩%)।
২৮ আগস্ট, ২০২১ তারিখের জাগোনিউজ এর সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত সংবাদ শিরোনামগুলো এরকম-১। নববধুকে দেখতে গিয়ে গাড়ি চাপায় নানি-দাদির মৃত্যু (সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ) ২। নোয়াখালীতে ক্যাভার্ডভ্যান-সি,এন,জি সংঘর্ষে চালক নিহত ৩। যাত্রাবাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল নারীর ৪। ফার্মগেটে বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় প্রান গেল ক্রিকেটারের ৫। সাতক্ষীরায় পরিবহণের ধাক্কায় প্রাণ গেল মোটর সাইকেল আরোহীর ৬। ভিক্ষা করতে বেরিয়ে ট্রাক চাপায় প্রাণ গেল নারীর ৭। শাহাজাদপুরে বাস চাপায় দুই মটর সাইকেল আরোহী নিহত ৮। ইঞ্জিন চালিত ভ্যানের ধাক্কায় মটর সাইকেল থেকে পড়ে এস আই নিহত ৯। সড়ক দুর্ঘটনায় তিন তারকাসহ ৫ জন আহত, দুইজন আইসিইউতে ১০। কুমিল্লায় ট্রাক-অটোরিক্সা সংঘর্ষে দুই নারী নিহত ১২। বরিশালে দুই বাসের সংঘর্ষে যাত্রী নিহত। এরকম ভুরি ভুরি মৃত্যুর খবর পত্রিকায় রয়েছে। অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ-ড্রাইভারের বেপরোয়া মনোভাব। আর এই মনোভাবকে নিছক দুর্ঘটনা বলা কী আদৌ উচিত হবে? না-কি হত্যা বলা হবে তা বিবেচনার ভার পাঠকের উপর রইলো।
প্রতিকারের কথা বললে অনেকের মনে বিরক্তির ভাব উদ্রেক হয়। শুনতে খারাপ লাগে। রিপিটেশন হয়। কোন নতুনত্ব নেই। তারপরেও বলতে হয়-সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ৬৬ থেকে ৭৫ ধারা বিবেচ্য ও প্রাসঙ্গিক। মেনে চলা ও মেনে চলতে বাধ্য করা অপরিহার্য।
অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে বেপরোয়া গতির কারণে। এটা চরম সত্যকথন। মহাসড়কে মাঝে মাঝে গাড়ি চালাই। ঘন্টায় ৬০ কি.মি. এর অধিক কখনো গাড়ি চালিয়েছি বলে মনে হয়না। অনেকে আমার গাড়ি চলা দেখে তীর্যক মন্তব্য করে, ‘’সকাল সন্ধ্যা এক্সপ্রেস’’। কেউ কেউ আঁতেল বলে চিৎকার দেয়। অথচ গবেষণা বলছে, গাড়ির গতি ঘন্টায় ১ কি.মি. বৃদ্ধি পেলে ৪-৫% দুর্ঘটনার আশংকা বেড়ে যায়। ৩০ কি.মি. ঘন্টা বেগে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯৯%। ৫০ কি.মি. ঘন্টা বেগে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৮০%। সড়ক পরিবহন আইন,২০১৮ এর ৪৪ ধারায় মটর যানের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ রয়েছে।
কুয়াশার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা হয় অনেক বেশি। এসময় গাড়ি চালনার বিশেষ কতিপয় নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। এ নিয়মগুলো জানতে হবে এবং মানতে হবে।
মহাসড়কে স্পিড গানের ব্যবহার, একটানা ৫ ঘন্টার অধিক গাড়ি না চালানো, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণসহ সচেতনতা বৃদ্ধি করে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যেতে পারে
মহাসড়কে স্পিড গানের ব্যবহার, একটানা ৫ ঘন্টার অধিক গাড়ি না চালানো, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণসহ সচেতনতা বৃদ্ধি করে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যেতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, আমরা বাবার কাঁধে আর ছেলের লাশ দেখতে চাইনা। যেকোন মূল্যে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা চাই। অন্যথায় আরো ঝড়বে মূল্যবান জীবন। আর অধরা থেকেই যাবে বহু আকাঙ্ক্ষিত নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন বাস্তবায়ন।
লেখক:
পরিচালক,পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল।