সমতলের নারীর জীবন আর পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃ-গোষ্ঠির নারীদের জীবন একেবারে উল্টো। এখানে নারীদের আর দশটি কাজের সাথে কৃষি, বাজারসদাই, জ্বালানি ও পানি সংগ্রহ এমনকি উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করার কাজটিও একহাতে সামলাতে হয়। জমি আর জুম চাষের মৌসুমে যেদিকে চোখ যাবে বিলে বিলে ধান বুনছেন শুধু নারীরাই। জুমে চোখ গেলে তাতেও একই চিত্র। কদাচিৎ এক দুইজন পুরুষের দেখা মেলে।
জুম চাষ ছাড়াও পাহাড়ি নারীরা পরিবারের বাড়তি উপার্জনের জন্য বানিয়ে থাকেন কোমর তাঁত। এতে তারা বাড়তি যে অর্থ পায় সেটি দিয়ে চলে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচও। বর্ণিল এই হস্তশিল্প একসময় সারাদেশেই সমাদৃত ছিলো। বিশেষ করে রঙিন ওড়না, কম্বল (বর্গি) এবং পরনের কাপড়ের পর্দার চাহিদা এখনও অনেক। আবার কেউ কেউ এসব দিয়ে নানা ধরনের ব্যাগ এবং মেদের পার্টস বানিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
খাগড়াছড়ির বেশির ভাগ পাহাড়ি পল্লীর নারীরা গৃহস্থালির কাজ আর জুম চাষের ফাঁকে কোমর তাঁতে পিনন ও থামি (শরীরের নিচের অংশের পরিধেয়/ চাকমা ভাষা) তৈরি করে স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করে থাকেন তারা। কাপড় বুনে প্রতি মাসে এক জন নারী পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে বলে জানা গেছে।
কিন্তু আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়ার কারনে নিজেরা টাকা দিয়ে সুতা কিনতে পারেননা। অন্যের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় বানিয়ে নির্দিষ্ট একটি পারিশ্রমিক পান মাত্র। এতে করে তাদের কষ্টের তুলনায় পাওয়া অর্থটি অনেক কম হয়ে যায়। তাদের জন্য নেই কোনো ব্যাংক লোনও।
পেশাগত জীবনে গাজীপুর মহিলা কলেজ’র অধ্যক্ষ ফেরদৌসি পারভীন, নেশায় ভ্রমণপিপাসু এবং পরোপকারী। বিশেষ করে পাহাড়ে ঘোরাঘুরির সুবাদে তাঁর সাথে পরিচয়প্রীতি ঘটে যায় খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত পল্লীর দরিদ্র অনেক নারীর। তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় থেকে শুরু করেন, ভিন্নধর্মী এক সহযোগিতা কার্যক্রম। তিনি খাগড়াছড়ির সাংবাদিক জাফর উদ্দিন এবং সফল নারী উদ্যোক্তা বীনা ত্রিপুরাকে খুঁজে পান তাঁর পাশে।
তিনি প্রকাশ করেন, তাঁর স্বপ্ন এবং পাহাড়ি নারীদের জীবনের বুননভিত বাস্তবায়নের রুপরেখাও। যেসব নারীরা বাজার থেকে উচ্চমূল্যে অথবা ধারকর্জ করে সুতা কিনে শ্রম দিয়ে কম লাভে বানানো কাপড় বিক্রি করেন, এমন নারীদের সন্ধানে সাপ্তাহিক হাটবারে নেমে পড়েন কয়েকটি বাজারে।
ফেরদৌস পারভীন করোনা’র মহা আকালে ২০২১ সালে ৪০ জনকে এবং গেলো বছর ৩০ জন নারীকে স্বাবলম্বী করার প্রত্যয়ে তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু করেন। তিনি নির্বাচিত এসব নারীকে কাপড় বানানোর চাহিদা অনুযায়ী সুতা কিনে দেন। যা দিয়ে কোমর তাঁতে প্রতিজন ৮ টি কাপড় বানাতে পারেন। যার বাজারে পাইকারি মূল্য ২৫-৩০ হাজার টাকা। এই টাকা থেকে লভ্যাংশ দিয়ে আবার সুতা কিনে কাপড় বুনে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে যে অর্থ আয় হচ্ছে তার একটি অংশ দিয়ে সুতা কিনছে। বাকীটা দিয়ে সংসারের চাহিদা মিটাচ্ছেন।
সুতা পেয়ে কাপড় বুনন করা সুজিতা ত্রিপুরা বলেন, আমার স্বামী তিন বছর ধরে অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারেননা। জুম চাষ করেও সংসার চালাতে পারিনা। মানুষের কাছ থেকে সুতা এনে বাসায় কোমড় তাঁত বুনতাম। এতে শুধু নির্দিষ্ট একটা বানি খরচ পেতাম। পরে ফেরদৌসী পারভীনের কাছ থেকে সুতা পেয়েছি। এই সুতা দিয়ে কাপড় বানিয়ে ২৪ হাজার টাকা পুঁজি হয়েছে। এখন আর টাকা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়না। খুব সুন্দরভাবে সংসার চালাতে পারছি।
সহায়তা পাওয়া ৭০ জন এখন সুতা দিয়ে কাপড় বানিয়ে সেই কাপড় বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে অধিক পরিমানে সুতা কিনে সম্প্রসারিত করেছে। এতে বর্তমানে ৭০ পরিবার সফল হয়েছে। তাদের এখন আর আগের মতো মানুষের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় বুনতে হয়না।
উপকারভোগী অঞ্জু ত্রিপুরার মেয়ে মিমি ত্রিপুরা বলেন, আমরা অনেক গরীব মানুষ। বাবা-মা জুম চাষ এবং কোমড় তাঁত বানিয়ে সংসার চালাতো। আমার মা মানুষের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় বুনতো এতে শুধু পারিশ্রমিক পেতো। কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে এসে এক ম্যাম মাকে সুতা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এই সুতা দিয়ে মা কাপড় বানিয়ে বিক্রি করে অনেক টাকা পেয়েছে সেগুলো দিয়ে আবার কিছু সুতা এনে এখন সারাদিন কাপড় বানায়। এখন আমরা অনেক ভালো আছি।
রমিতা ত্রিপুরা বলেন, আমি যে সুতার সহযোগিতা পেয়েছি তা আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি যে এমন সহযোগিতা পাবো। আগে আমি মানুষের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় বুনতাম। এখন ম্যাম যে সুতা দিয়েছে তা দিয়েই আমি সফল। কাপর বিক্রি যে টাকা পেয়েছি তার কিছু অংশ দিয়ে সুতা কিনে বাকী টাকা অন্য কাজে লাগিয়েছি।
এই পরিবারগুলো অর্থের অভাবে সুতা কিনে কোমড় তাঁত বানাতে পারত না। মানুষের কাছ থেকে সুতে এনে পারিশ্রমিক হিসেবে কোমর তাঁত বানাতো। কিন্তু ওনার কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার পর এখন আর মানুষের কাছ থেকে নিতে হয়না। এখন তারা নিজের মতো করে স্বাবলম্বী হয়ে গেছেন। এই ৭০ জনের পরিবার এখন আগের ছেয়ে অনেক বেশি ভালো আছেন।
এই পাহাড়ি নারীদের কাছ থেকে বানানো কাপড় কিনে নেওয়া নারী উদ্যোক্তা বীনা ত্রিপুরা জানান, আমাদের পাহাড়ি নারীরা সংসারে পুরুষের পাশাপাশি অনেক ভুমিকা পালন করে থাকে কোমড় তাঁতের মাধ্যমে। কাপড় বানিয়ে সংসারে সচ্ছলতা নিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু অর্থের অভাবে তারা সেটা পারেনা। মানুষের কাছ থেকে ধাদন নিয়ে কাজ করে সেটা থেকে কিচু উপার্জন করে সংসারে দিতো। তাদের এই কাজের সহযোগিতা করার জন্য পারভীন ম্যাম এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সহযোগিতা পাওয়া পরিবারগুলো স্বাবলম্বী হয়ে গেছে। তাদের এখন আর পিছনে পিরে তাকাতে হয়না।
পাহাড়ি নারীদের সহায়তাকারী অধ্যক্ষ ফেরদৌসী পারভীন বলেন, আমি যখন কলেজে চাকরি করি তখন থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। চাকরি জীবন থেকে অবসরে যাওয়ার পর ভাবলাম অন্য কিছু করা যাক। পাহাড় আমার বরাবরই ভালো লাগে। সে সুবাদে খাগড়াছড়ি গিয়েছি ঘুরতে। সেখানে সুহৃদদের সঙ্গে আমার পরিচিতি ঘটে। তাদের মাধ্যমেই নৃতাত্ত্বিক মানুষের দুর্দশার কথা জানতে পারি। তাদের কর্মস্পৃহার ও পরিশ্রমের কথা। তাদের পূঁজির অভাব তাই সুতো কিনে কোমড় তাঁত বুনতে পারেনা। আমি তখন সিদ্ধান্ত নেই পূঁজি দিয়ে তাদের সাহায্য করবো। সেই থেকে দুই বছরে ৭০ জনকে এই সহযোগীতা করি। সেখান থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তারা সকলেই নারী। এখন আয় করে পরিবারে সহায়তা দিচ্ছে। তিনি আগামীতে আরো বেশি পরিসরে সহায়তা করবেন বলেও আশ্বাস দেন পাহাড়ের মানুষের।