ধান চাষে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার কৃষকরা চরম দুরবস্থার সম্মুখীন। সার, বীজ, ডিজেল, কীটনাশক, সেচসহ কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি উৎপাদনের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে জমি চাষ ও সেচ ব্যয় বেড়ে গেছে যা ধান চাষে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে এনে কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ছে।
মোট উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রির পর পাওয়া অর্থ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লাভ কমছে। ফলে কৃষকরা তাদের বিনিয়োগে কম রিটার্ন পাচ্ছেন। কারণ তাদের উৎপাদিত পণ্যের দামের তুলনায় উৎপাদন খরচ দ্রুত বাড়ছে। এই প্রবণতা ধানচাষিদের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
এদিকে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে কৃষক থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করা হয়। পাহাড়ে বেশিরভাগ কৃষক ই নিরক্ষর। ক্রয়কৃত ধানের টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে হয় বিধায় অনেক কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে চান না। তাছাড়া তারা সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে নগদে বিক্রি করতে পারে বিধায় কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করেন না।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মাটিরাঙ্গায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩১ টাকা দরে ৫০ মেট্রিকটন বোরো ধান সংগ্রহ করা হয়। একইসাথে আমন ধান সংগ্রহ করা হয় ৬০ মেট্রিকটন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতি কেজি ধান ৩২ টাকা দরে বোরো ধান সংগ্রহ হয় ৬৯ মেট্রিকটন। আমন ধান সংগ্রহ হয় ৫১ মেট্রিকটন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতি কেজি আমন ধান ৩৩ টাকা দরে সংগ্রহের পরিমাণ কমে ১৫ মেট্রিকটন। এ বছর সরকারিভাবে ধান সংগ্রহে কৃষকের অনাগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। প্রতি কেজি ধান মানভেদে স্থানীয় বাজারে ৩৪-৩৫ টাকা করে বিক্রি করছে কৃষক। এতে করে কৃষকের ভোগান্তি নাই মাড়াই করার সাথে সাথেই নগদ টাকায় ধান বিক্রি করতে পারছেন। তাছাড়া সরকারিভাবে আর্দ্রতা ১৪% বিজাতীয় ০.৫% ভিন্নজাতেন ধানের মিশ্রণ ৮% অপুষ্ট ও বিনষ্ট দানা ২% চিটা ০.৫% মেনেই সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করার বিষয় টি তারা ভোগান্তি হিসেবে নেন। এত জামেলায় তারা ধান বিক্রি করতে নারাজ। সুতরাং, কৃষকের উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য করে দাম নির্ধারণ করে নগদ টাকায় ক্রয় করতে হবে বলে জানিয়েছেন একাধিক কৃষক।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মাটিরাঙ্গায় প্রতি কেজি বোরো ধানের উৎপাদন খরচ প্রায় ২৪ টাকা। তবে এক ফসলি জমিতে খরচ আরো বেশি হতে পারে। ১ কেজি ধান উৎপাদনে খরা মৌসুমে মোট ১৬০০ -২০০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। বেলে ধোঁয়াশ মাটিতে পানি বেশি লাগে। এঁটেল মাটি হলে পানি পরিমাণে কম লাগে। তবে, পানি খরা বা বাষ্প হয়ে নষ্ট না হলে ১ কেজি ধান উৎপাদন করতে ৫৫০-৬৫০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। বোরো মৌসুম পুরোটাই পানি নির্ভর হলেও ফলন বেশি হয়। আমনের মৌসুমে পানি লাগেনা তখন বৃষ্টির সিজন হওয়ায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি পাওয়া যায় তখন ফলন ও ভাল হয় খরচ হয় কম। আউশে খরচ লাগে তবে বোরোর তুলনায় কম। তাছাড়া প্রতি বিঘা জমিতে কৃষকের ৬হাজার টাকার সার ও কীটনাশক খরচ হয়। এত বিশাল উৎপাদন খরচের চাপে জমি বর্গা করে লাভের মুখ দেখেন না কৃষক।
মাটিরাঙ্গা প্রত্যান্ত পাহাড়ি জনপদ হবার দরুন ভূগর্ভস্থ ২৫০-৩০০ ফুট মাটির নিচে পানির লেয়ার পাওয়া যায়। তাই এ স্থানে জমিতে পানির খরচ ও বেশি। মাটিরাঙ্গায় ছোট ছোট চড়া বা খাল থাকার দরুন তৎসংলগ্ন এলাকায় কৃষি জমিতে ওইসব উৎস থেকে পানি সেচ দেয়ার সুবিধা রয়েছে। যদিও উত্তোলন খরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এদিকে মাটিরাঙ্গায় প্রতি কানি জমিতে ২৫০০-৩০০০ টাকার পানিসেচ দিতে হয়। একই সাথে ট্রাক্টর দিয়ে প্রতি কানি জমি চাষের জন্য ৩০০০ টাকা গুনতে হয় কৃষক কে।
কৃষকের উৎপাদন খরছ কমাতে জৈব সার ব্যবহারের প্রতি জোর দিতে হবে জানিয়ে মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কৃষি কর্মকর্তা মো. সবুজ আলী বলেন, মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যেগে ভার্মি কম্পোস্ট ও ট্রাইকো কম্পোস্ট জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। মাটিরাঙ্গায় এসব জৈব প্রযুক্তির সার ব্যাবহার চলমান রয়েছে। যদিও মাটিরাঙ্গার কৃষকরা জৈব সার ব্যবহার করেন কম।
উপজেলা কৃষি অফিস আরো জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বমোট ৩০০০ কৃষকের মাঝে কৃষি প্রণোদনা প্রদান করা হয়। তার মধ্যে ৪০০ জনকে আউশ প্রণোদনা, ৬০০ জনকে আমন এবং ২০০০ জনকে বোরো মৌসুমের প্রণোদনা প্রদান করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সর্বমোট ২৬০০ জন কৃষকের মাঝে কৃষি প্রণোদনা বিতরণ করা হয়। একই সাথে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ১০০ জনকে আমন পুনর্বাসন করা হয়। প্রতি ১ জন কৃষক ৫ কেজি উফশী জাতের বীজ ধান, ১০ কেজি ডিএসপি, ১০ কেজি এমওপি সার প্রদান করা হয় যা অত্র মাটিরাঙ্গা উপজেলার মতো বিশাল জনগোষ্ঠীর কৃষকের প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অনেক কৃষকের বাড়ি মাটিরাঙ্গা সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূর তারা পরিবহন ভাড়া দিয়ে কৃষি অফিসের এসব প্রণোদনা গ্রহণ করেন না।
আমতলীর কৃষক নুর আলম বলেন, আগে মজুরি প্রতিজন ৫০০ টাকা ছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির সাথে শ্রমিকের দামও বাড়ছে। এখন ধান কাটা মজুরি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। বাপ-দাদারা কৃষি কাজ করতো। তাই লেগে আছি। পেশায় মায়া জমে আছে বিধায় ছেড়ে যেতে পারি না। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় শখের কৃষি ছেড়ে দিতে হবে।
চড়পাড়ার কৃষক আব্দুর রব বলেন, আমি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে কৃষির কাজ করছি। আগের তুলনায় এখন কৃষি কাজে খরচ বেশি লাভ কম হয় মাঝে মাঝে লোকসান গুনতে হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরনের হতে হলে সরকারি সহায়তা ও ভর্তুকি বাড়াতে হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে এবং সরাসরি বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই হয়তো কৃষকের দুর্দশা কিছুটা লাঘব হবে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. সবুজ আলী বলেন, বর্তমানে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রমিক, চাষ, এবং সেচের খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং কৃষি খরচ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া কৃষকদের সচেতনতা এবং সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন, যাতে তারা নতুন প্রযুক্তি ও কৃষি কৌশলগুলো গ্রহণ করে তাদের উৎপাদন খরচ কমাতে পারেন।