পাহাড়ে ভয়ংকর কেএনএফ !

NewsDetails_01

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবান সবচেয়ে শান্ত ও সম্প্রিতির জেলা হিসাবে পরিচিত থাকলেও গত বছর থেকে কেএনএফ এর শসস্ত্র কর্মকান্ড, জঙ্গিদের অভয়ারণ্য, হত্যা, প্রায় প্রতিদিন গোলাগুলি, অপহরণের ঘটনায় শান্তিচুক্তি পূর্বাবস্থায় ফিরছে নাতো পাহাড়? এমন প্রশ্ন এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে।

সূত্রে জানা যায়,’কুকি-চিন রাজ্য’ নামে একটি পৃথক রাজ্যের দাবিতে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) মনে করে, পাহাড়ের ৯টি উপজেলা তাদের পূর্ব-পুরুষদের আদিম নিবাস, দখলদাররা অনুপ্রবেশ করে তাদের ভূমি দখল করে নেয় এবং কোটাসহ সরকারি বিভিন্ন সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। জেএসএস’সহ অন্য সংগঠন গুলো তাদের ভূমি ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করে বিভিন্ন অপরাধ করছে, তাই এসব থেকে মুক্তি পেতে এই সংগঠন এর সৃষ্টি। সংগঠনটি ২০১৭ সালে কেএনভি নামে সশস্ত্র সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে শতাধিক সক্রিয় সদস্য কাচিন, কারেন প্রদেশ এবং মনিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণে পাঠায়। ২০১৯ সালে কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষে শসস্ত্র অবস্থায় ফিরে আসে। দেশের রুমা সীমান্ত ও ভারতের মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত এ সংগঠনের শসস্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে মোট ৬শ এর বেশি সদস্য আছে। বর্তমানে তারা বান্দরবান ও রাঙামাটির অন্তত ৫টি উপজেলায় ঘাঁটি গেড়ে এসবিবিএল, একে ৪৭, এসএমজি, পিস্তল, নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরী ল্যান্ড মাইন্ড ব্যবহার করে অপরাধ মূলক কর্মকান্ডে জড়িত।

পর্যটন শিল্পে ধ্বস:
বান্দরবানের সীমান্ত এলাকায় জঙ্গী সংগঠন ও কেএনএফ এর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযানের কারনে গত ১৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া পর্যটক যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞায় জেলার অন্তত দুই শতাধিক হোটেল-মোটেল কার্যত পথে পথে বসার অপেক্ষায়, অনেক তাদের কর্মচারী ছাটাই করেছে। অন্যদিকে জেলার থানচি ও রুমার ২ শতাধিক নৌযান, জেলার পর্যটক বহনকারী ৩ শতাধিক চাঁদের গাড়ি ও ৩শ জন ট্যুরিষ্ট গাইড এখন বেকার সময় কাটাচ্ছে, জুম চাষাবাদ করতে না পারার কারনে পাহাড়ীরা নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছেনা, ফলে অর্থনৈতিক ভাবে চরম সংকট পার করছে ব্যবসায়িরা।

থমকে গেছে উন্নয়ন কার্যক্রম:
জেলার তিন উপজেলায় অপহরণ, গুলি বর্ষণ, হত্যা ও বন্দি করার কারনে সরকারের সড়ক নির্মান, ব্রিজ, কালভার্ট ও স্কুল ভবন নির্মানে কাজ করা শ্রমিকরা তিন উপজেলা ছাড়ছে। যেকোন সময় অপহরণের শিকার হতে পারে এমন ভাবনায় তারা জেলা সদরে ফিরছে, অন্যদিকে জেলা থেকে শ্রমিকরা উপজেলায় উন্নয়ন কাজ করতে যেতে চাচ্ছেনা, ফলে স্থবিরতা বিরাজ করছে উন্নয়ন কর্মকান্ডে।

শিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে পাহাড়ী শিশুরা:
কেএনএফ ও জঙ্গী বিরোধী যৌথ বাহিনীর অভিযানের কারনে গত জানুয়ারি থেকে রুমার ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাইন্দু ইউনিয়নের মুয়ালপি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আরথাহ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাসতলাং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মুননুয়াম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের পাকনিয়ার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কেসপাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেড় শতাধিক শিশুর শিক্ষা জীবন অনিয়শ্চতার মধ্যে পড়েছে।

NewsDetails_03

যাতায়তেও কেএনএফ এর নিষেধাজ্ঞা:
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িতে চলাচল করা পরিবহণের মালিক সমিতিকে যৌথ বাহিনীর চলমান অভিযানে গাড়ি না পাঠানোর জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে কেএনএফ। এই নিষেধাজ্ঞার পর গাড়ি চালকদের উপর গুলিবর্ষণ ও দুই দফায় অপহরণের মতো ঘটনা ঘটে। গত ১৫মার্চ বান্দরবান- রুমা, রোয়াংছড়ি, থানছি সহ চিম্বুক সড়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাত ৭ টার পর থেকে সব ধরণের গাড়ী যাতায়াত না করার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে উক্ত তিন উপজেলা সড়কে চলাচলকারী যানবাহন চালকদের মধ্যে চরম আতংক বিরাজ করছে।

শান্তি বহুদূর :
যৌথ অভিযানের সময় ২ কেএনএফ সদস্য ও কেএনএফ এর গুলিতে মগ পার্টির ৩ জন নিহত হয় এবং ১১ মার্চ থানচি থেকে কেএনএফ ১২ জন নির্মান শ্রমিককে অপহরণ করে। এদের মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয় এবং ৪ জনকে জিম্মি করে রাখে। ১২ মার্চ দুপুরে কেএনএফ এর গুলিতে সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন মারা যায় এবং দুই জন সেনা সদস্য আহত হয়। ১৫ মার্চ রুমার লংথাসি ঝিরি এলাকায় সড়কে কাজ করতে গিয়ে কেএনএফ সদস্যরা অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট আনোয়ারসহ ৯ জনকে ধরে নিয়ে যায়। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বম সম্প্রদায়ের ৩০ জনকে যৌথ বাহিনী আটক করার দাবী জানিয়ে গত ১৮ মার্চ এক বার্তায় কেএনএফ তাদের মুক্তির দাবি জানায়, তা না হলে আনোয়ার হোসেন কে হত্যা করা হবে বলে জানায়। গত ১৮ মার্চ কেএনএফ দাবি করে, তাদের দাবিকৃত জায়গায় ল্যান্ড মাইন এবং বোমা ফাঁদ পাতা হয়েছে। অন্যদিকে যৌথ বাহিনী জানায়, এই সময়ে পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৬৮জন জঙ্গী ও কেএনএফ এর বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়।

ভয়ে এলাকা ছেড়েছে যতজন :
গত বছরের ১৫ নভেম্বরের পর ১৩২ টি পরিবারের ৫৪৮ জন মানুষ মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে। গত ২৮ জানুয়ারি মুলপি পাড়া থেকে রুমা সদরে ১৪০ মারমা নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয় গ্রহন করলেও তারা গত ৫ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসায় ফিরে যায়। ১০ মার্চ রাঙামাটির বিলাইছড়ির ৪নং বড়থলি ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড এর ৩টি পাড়া থেকে ৫৬ পরিবারের ২২০জন তংচঙ্গ্যা রেইছা ও রোয়াংছড়ি সদরে আশ্রয় গ্রহন করে।

কেএনএফ-এ কোন্দল!
সূত্রে জানা যায়, কেএনএফ এর সহায়তায় বম সম্প্রদায়ের অনেকে মিজোরামে আশ্রয় নিলেও তাদের অনেকে চেন্নাই ও বেঙ্গালোরের বিভিন্ন হোটেলে কাজ করতে পাড়ি জমান। তারা শসস্ত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহন না কারার কারনে তাদের উপর কেএনএফ ক্ষুদ্ধ হয়। এসব বিষয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও সংগঠনটির চিফ অফ স্টাফ পানতালা হ্যাডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ভানচুন লিয়ান মাষ্টার এর উপস্থিতিতে মিজোরামের লংতালাই জেলার হুমুনুয়াম গ্রামে এই দ্বন্ধ নিরসনে গত ১০ মার্চ বৈঠক ডাকে। এই বৈঠক থেকে আসাম রাইফেলস কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেসিএনএ) এর দুই ক্যাডার রুমার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের সালৗপি পাড়ার নাথান বম এর সহকারি জিংরামলিয়ান বম (৩২) ও রোয়াংছড়ির অবিচলিত পাড়ার (গিলগার) পাড়ার কেএনএফ কমান্ডো পাজাউ বম (২২) কে গ্রেপ্তার করে। আসাম রাইফেলস দাবি করে, তারা মিয়ানমারে অস্ত্র পাচার করছে। এসময় নাথান ও শিক্ষক ভানচুন লিয়ান মাষ্টার পালিয়ে যায়।

যা ভাবছে স্থানীয়রা:
জেলা শহর থেকে রোয়াংছড়িতে রং এর কাজ করতে যাওয়া ঠিকাদার আশিষ দেবনাথ বলেন, পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কারনে, জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা কাজ ফেলে শ্রমিকদের নিয়ে জেলা সদরে চলে এসেছি।
বান্দরবান, হোটেল মোটেল মালিক সমিতির অর্থ সম্পাদক রাজিব বড়ুয়া বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারনে আমাদের পর্যটন ব্যবসায়িদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, তা বলে বুঝাতে পারবোনা, আর এসব থেকে পরিত্রান আশা করি।
বান্দরবান জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মো: মুসা বলেন, আগে কখনও কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠি গাড়ি চালকদের আক্রমন করতো না, এখন যেভাবে আক্রমন ও অপহরণ হচ্ছে,তাতে আমার উদ্বিগ্ন। আশাকরি সবার প্রচেষ্টায় এসব বন্ধ হবে।
এই ব্যাপারে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা বলেন, এলাকার সব সম্প্রদায়ের শান্তির জন্য তাদের সব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সমর্পণ করা উচিত, তাহলে এই এলাকায় শান্তি বিরাজ করবে।

প্রসঙ্গত,১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে সরকার পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করলে তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে শান্তিপূর্ন জেলা বান্দরবানে ফের শান্তি ফিরবে, বাঙালীসহ ১১টি জাতীগোষ্ঠির মধ্যে সম্প্রিতি বজায় থাকবে এমন আশা স্থানীয়দের।

আরও পড়ুন