রাতের আকাশে জ্বলে কতো তারা, আবার কতো তারা নিভে যায়। এমনি করে প্রতিদিনের তারা ঝলমল আকাশের মতো আমাদের সবচেয়ে কাছের যে তারাটি উজ্জ্বলতা ছড়াতো, সেটিই আজ খসে গেল। তিনি হলেন বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম নক্ষত্র এই পার্বত্যাঞ্চলের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা চিং হ্লা মং চৌধুরী(মারী)। যিনি পার্বত্যাঞ্চলের ফুটবলার হিসেবে এ অঞ্চলকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়।
ফুটবলার মারীর জন্ম ১৯৩৮সালের ২৯সেপ্টেম্বর রাঙামাটি জেলার চন্দ্রঘোনায়। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় রবিশালের ব্যাপ্টিষ্ট মিশন বয়েজ স্কুলে। তিনি ১৯৫৩সালে এ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৫৬সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৫৯ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
স্কুল বেলা থেকে মারীর খেলাধুলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। যেখানে খেলা হতো এ খেলাপ্রিয় মানুষটি দৌঁড়ে ছুঁটে যেতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় কলেজে পড়ালেখায় থাকাকালীন দেশের সেসময় নামকরা ফুটবল দল ঢাকা আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, ফায়ার সার্ভিস, ওয়ান্ডারার্স ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে থাকাকালীন সময়ে কলকাতা ফুটবল লীগে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি দীর্ঘদিন ইপিআইডিসি, বিজি প্রেস এবং টিসিবি’র ফুটবল টিমগুলিতে ফুটবল কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের ফুটবলের পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ১৯৫৬,৫৭ ও ৫৮সালের পাকিস্তান ফুটবল টিমের পক্ষে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৫৬সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবল সাদা টিমের অধিনায়ক থাকাকালে এই সাদা টিমটি চ্যাম্পিয়ন হয়।
ফুটবলের পাশাপাশি স্বাধীনতা যুদ্ধকালে আগরতলায় ১নং সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়ার অধীনে কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে দশ মাস কাজ করেন। জাতীয়, আন্তর্জাতিক ফুটবলের পাশাপাশি তিনি পার্বত্যাঞ্চলে ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ, প্রতিনিধিত্ব, অধিনায়ক ও কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ ফুটবলার সারাজীবন ফুটবল খেলার পেছনে দৌঁড়েছেন। অর্থের মোহে না থেকে খেলার পেছনে সময়, শ্রম দিয়ে গেছেন। খেলার জন্য তিনি সবকিছু সহ্য করতে পারতেন। খেলার জন্য একসময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দৌঁড়েছেন। পরিবারকে সময় পর্যন্ত দিতে পারেনি। সারাজীবন ফুটবলের পেছনে সময় দিতে দিতে মৃত্যুর আগে তাঁকে দেখার জন্য সময় হয়নি কারো। যে মানুষটি সারাজীবন ধরে ক্লাবগুলোর জন্য খেলে গেলেন তারাও তাঁর খবর রাখলো না। কিন্তু, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে একদিন তাঁরও জীবন অবসান হয়।
চিরবিদায় ঘটে পার্বত্যাঞ্চলে জন্ম নেওয়া এ সম্রাটের। পতন হয় দেশের ফুটবলের আরেক নক্ষত্র। গত ৯মে ফুটবলার মারী,আমাদের পার্বত্যাঞ্চলের মারী বিদায় নেন। ১০মে কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টান হাসপাতাল মাঠে শেষ রাষ্ট্রীয় সম্মান হিসেবে গার্ড অব অনার প্রদান করে খ্রিস্টান কবরস্থানে সমাধি দেওয়া হয়।
২০০১ সালে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ হতে মারীকে ‘সেরা ফুটবলার’ হিসেবে সম্মাননা প্রদান করে। ক্ষণজন্মা এ নক্ষত্রের স্মৃতি-তর্পণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে ফুটবলের অতীত, ফুটবলের ইতিহাস। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রজন্মের মাঝে বিকশিত হবে ভবিষ্যতের নক্ষত্ররা।