বর্ষীয়ান শিক্ষানুরাগী মংহ্লা প্রু চৌধুরী : গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামী

NewsDetails_01

বর্ষীয়ান শিক্ষানুরাগী মংহ্লা প্রু চৌধুরী
বৃটিশ আমলে গুইমারা’র পরিচিতি ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ন বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে। পাহাড়ি কাঁঠাল, কলা, কচু, মৌসুমি শাক-সবজি এবং জুম ফসলের উর্বর এক কৃষিপ্রধান এলাকা। তাই গুইমারা বাজারের পরিচিতি ছিলো বৃহত্তর চট্টগ্রামেও। দেশ স্বাধীনের পরও খাগড়াছড়ি অঞ্চলের প্রাচীন জনপদ গুইমারা ভৌগলিকভাবে যেমন দুর্গম ছিলো, তেমনি ছিলো অনুন্নত এক জনবসতি। মং সার্কেলের খুব কাছের এই জনপদ শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর পাহাড়ি জনপদ। বিশেষত: মং রাজ পরিবারের সামন্ত চিন্তার কারণে দেশ স্বাধীনের পরও গড়ে উঠতে পারেনি খুব বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকের কাপ্তাই বাঁধের পর দ্রুত পাল্টে যায় এই অঞ্চলের জনমিতি। মারমা জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত গুইমারা এলাকায় পূর্নবাসিত করা হয় বাঁধের কারণে উদ্বাস্তু বিপুল সংখ্যক চাকমা-মারমা এবং বাঙালি জনগোষ্ঠিকে। ফলে মানুষের প্রয়োজনেই শুরু হতে থাকে নানামুখী উন্নয়ন কর্মকান্ড। সবকিছু ধীরে ধীরে সামনে এগোলেও একটি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি। তখন এলাকার গুটিকয় পরিবারের সন্তানরা অনেক কষ্টে দূরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ শেষ করতে পারতো। পরিবারের সদিচ্ছা এবং সামর্থ্যরে সমন্বয় ঘটলে কেউ কেউ রামগড়, ফটিকছড়ি, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেতো। গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেকার অবস্থার কথা এভাবেই বলছিলেন একজন ‘মংহ্লা প্রু চৌধুরী’।
তাঁর বাবা মথু চৌধুরী। চার চারটি মৌজার হেডম্যান এবং গুইমারা অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত জমিদার ছিলেন। তাঁর রেকর্ডিয় এক একর জায়গাতেই ১৯৬৩ সালে আজকের গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন ঘটে।
মংহ্লা প্রু চৌধুরী বয়ানে জানা যায়, ১৯৬১ সালে তিনি বৃহত্তর গুইমারা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৮ বছর। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই মাথায় একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। পরিবারের অনেক বিত্ত-বৈভব থাকলেও শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের অভাবে হাইস্কুলে গন্ডি না পেরিয়েই নিজের শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে হয়েছিল। তাঁর চেষ্টাতে ‘রাঙামাটি ডিস্টিক্ট কাউন্সিল’ থেকে বেশকিছু এলাকায় স্থাপিত হলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছাত্র-ছাত্রীর সংকটে বিদ্যালয়গুলো বার বার স্থানান্তরিত করতে হতো। শিক্ষকও খুব বেশি ছিলনা। সে যাক, যে কজন ছাত্র-ছাত্রী প্রাইমারি শেষ করতো; তাঁরা পড়বে কোথায়?
এমন সব দুশ্চিন্তা থেকেই উৎসারিত হয়েছিল আজকের গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। শিক্ষকের আকাল, তাই গুইমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সবেধন কয়েকজন শিক্ষক আর গুটিকয় শিক্ষার্থী নিয়েই যাত্রা শুরু। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত জায়গা থেকে এক একর ধান্য জমি এবং এক একর টিলাভূমি জায়গা তরুণ জনপ্রতিনিধি নি:শর্তে গুইমারা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য দান করে দিলেন। স্কুলঘর বানাতে হবে। আসবাবপত্র, শিক্ষকদের বেতন এবং অন্যান্য ব্যয় কোত্থেকে আসবে? তাঁরই ইউনিয়ন কাউন্সিলে সচিব ছিলেন, মংপাই মারমা। যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধীতাকে ডিঙ্গিয়ে কলকাতা থেকে স্নাতক উত্তীর্ন একজন তরুণ। সেসময় পুরো এলাকাতে তাঁর মতো মেধাবী এবং উচ্চ শিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বও দেয়া হলো, মংপাই মারমাকেই। প্রয়াত মংপাই মারমা-ই গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে আছেন। তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
মংহ্লা প্রু চৌধুরী বলেন, বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে তৎকালীন জমিদার উচাই মারমা (স্থানীয় কার্বারী এবং মহাজন) এক হাজার আড়ি, প্রয়াত পুলিন চন্দ্র সিংহ (তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী) ৩’শ আড়ি এবং রি প্রু চাই মহাজন (মারমা) দেড়’শ আড়ি ধান স্কুলের জন্য দান করেছিলেন। এছাড়া কয়েক বছর অগ্রহায়ন মাসে পাড়ায় পাড়ায় গণচাঁদার মতো ধান সংগ্রহ করা হয়েছিল। বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে পরে মংহ্লা প্রু চৌধুরী আরো ৪০ শতক জায়গা নিজের টাকায় কিনে দিয়েছিলেন।
তিনি জানান, স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এগিয়ে আসেন প্রয়াত পথু চৌধুরী (হাফছড়ি ইউপি’র বর্তমান চেয়ারম্যান চাইথোয়াই চৌধুরী’র পিতা এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী’র পিতামহ)। পথু চৌধুরী বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। সাথে তাঁরই সন্তান তৎকালীন ইউনয়ন কাউন্সিল সদস্য মংসাজাই চৌধুরীও মনোনিবেশ করেন বিদ্যালয় গড়ার মহৎ কাজে। বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী’র পিতা মংসাজাই চৌধুরী আশির দশকে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হাতে আশির দশকে প্রাণ হারান।
তবে স্কুলটি ঘুরে দাঁড়ায় ‘৬৭ থেকে ‘৬৯ সাল সময়কালে। এসময় বিদ্যলয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। যিনি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র সভাপতি।
তিনি দায়িত্ব নিয়েই বাড়ি বাড়ি গণসংযোগ শুরু করেন। শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বাড়ান এবং স্কুলের জন্য একটি ফান্ড সৃষ্টিতে সফল হন।
বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক নথি থেকে জানা গেছে, সন্তু লারমা’র পরে হরি মোহন বণিক (১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩), শুধাংশু রঞ্জন পাল (১৯৭৩ থেকে ১৯৯৫), আবুল হোসেন চৌধুরী (১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭), আবু বকর সিদ্দিকী (১৯৯৭-১৯৯৮), কাজী সামছুল হুদা (চার মাস), দ্বিতীয় মেয়াদে আবু বকর সিদ্দিকী (১৫-১-৯৮ থেকে ১-৫-২০০০), ব্রজনাথ রোয়াজা (২-৫-২০০০ থেকে ২৮-৮-২০০৮) এবং তখন থেকে অদ্যাবধি সুশীল রঞ্জন পাল গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। গুইমারার প্রবীন শিক্ষাবিদ তাজুল ইসলাম। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বলেন, আমি ১৯৬২ সালে ফেনী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম। তখন গুইমারা বাজারে বড়ো ভাই আব্দুল মালেক (প্রকাশ মাজু মিয়া)-র কাপড়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। তাঁর সুবাদে ১৯৬২ সালে তাঁর সুবাদে প্রথম গুইমারায় আসা হয়। মনের টানে আবার ফেনী চলে যায়। ১৯৭২ সালে আবার গুইমারায় ফিরে আসি। তখন গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো থেকে শুরু করে সবকিছুর নাজুক অবস্থা।
তাঁর বয়ানে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাঞ্জাবী সৈন্যরা বিদ্যালয়টিকে জোরপূর্বক তাঁদের ঘাঁটি বানিয়েছিল। ফলে বিদ্যালয়টি আর ব্যবহার উপযোগী থাকেনি। প্রধান শিক্ষক হরি মোহন বণিক, একাই ছিলেন। বায়াত্তর সালের প্রথম দিকে কোন এক মঙ্গলবার বাজারের দিনে কথার ছলে মংসাজাই চৌধুরী মাজু ভাইয়ের কাছে আমাকে শিক্ষক হবার প্রস্তাব করেন। দায়িত্ব নিয়েই দেখি বিদ্যালয়ে ২৫/৩০ কেজি ওজনের সিন্ধুক লবণের একটি তাক পড়ে আছে। চারদিকে ময়লা-আর্বজনার স্তুপ। সবকিছু পরিস্কার করে প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র হিসেবে পেলাম একটিমাত্র ছাত্র ভর্তির রেজিস্ট্রার। সম্ভবত মার্চ মাসের দুই তারিখ ক্লাস শুরু করি। এক-দুইদিন পর ৬ষ্ঠ থেকে অষ্ঠম শ্রেণি পর্যন্ত ২৩ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে শুরু হয় বিদ্যালয়টির নবযাত্রা।
এসময় পুরানো প্রতিষ্ঠাতাদের সাথে বিদ্যালয় পূর্নগঠনে যোগ দেন সুশিক্ষিত রুইসা প্রু মারমা, ধনীরাম মহাজন (ত্রিপুরা), নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরা, গোপাল কৃষ্ণ দেওয়ান এবং জয়কুমার হাবিলদার (মারমা)।তিনি বলেন, আশির দশকের প্রথমদিকে বিদ্যালয়টি উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জি কে দত্ত’র অবদান অনস্বীকার্য। দাপ্তরিক সকল কাগজপত্র তৈরি এবং প্রাতিষ্ঠানিক নথি প্রনয়ণে তিনি আমাদের অনুদার সাহায্য-শ্রম দিয়েছেন।
গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা মংহ্লা প্রু চৌধুরী সম্পর্কে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী’র শ^শুর। তিনিও গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচের মেধাবী ছাত্র। তাঁর মতে, গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়টি এই জনপদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে আলোকিত করেছে। পূর্ব প্রজম্মরা সুশিক্ষার এই আলো না জ্বালালে আজকে বৃহত্তর গুইমারার বাসিন্দারা অনেক পিছিয়ে থাকতেন।
তিনি জানান, বর্তমান সরকার গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়কে এরিমধ্যে সরকারিকরণের ঘোষণা দিয়েছে। শিগগির এটি একটি সরকারি হাইস্কুল হিসেবে নতুন যগে পা দেবে। এবং আরো বেশি সুনামের সাথে দিকে দিকে শিক্ষার আলো ছড়াবে।
বিদ্যালয়টির বর্তমান প্রধান শিক্ষক সুশীল রঞ্জন পাল জানান, পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে-বিদেশে নিজেদেরকে আলোকিত করেছেন। এরমধ্যে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী রাজীব পাল, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নয়ন জ্যোতি চাকমা, ডা. সুবর্ণা পাল, ব্যারিস্টার সোমা পাল এবং বিশিষ্ঠ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী অশোক পাল অন্যতম।

আরও পড়ুন