বর্তমানে এক ধরনের তান্ত্রিক ও কবিরাজের লিফলেটে ভরে গেছে দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন ভবনের দেয়াল। নজর কাড়া রঙিন লিফলেটে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছে। আর এসব পোস্টারে মানুষের সহানুভূতি পেতে ও বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জনের জন্য বান্দরবানসহ অপর দুই পার্বত্য জেলার কবিরাজ বা বৈদ্য বলে পরিচয় দেওয়া হলেও তারা পার্বত্য জেলার বাসিন্দা নন, মানুষের বিশ্বাস অর্জনের জন্য মূলত দেশের বিভিন্ন জেলার প্রতারকরা পার্বত্য জেলার তান্ত্রিক, কবিরাজ, বৈদ্য বলে প্রচার করে এই কাজটি করছে অবলীলায়। আর এ নিয়ে এস বাসু দাশ এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
আরো জানা গেছে, এসব তান্ত্রিকদের লিফলেট বা পোস্টারে কোনোটায় গাছের শিকর, কবুতর, সাপ, বেজি, গাছ, মানব কঙ্কালসহ নানা কিছুর ছবি, আবার কোনটায় নারী পুরুষের ছবি। আর এই লিফলেটে শোভা পায় ক্যান্সার চিকিৎসা, করোনা মুক্তি, স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বিয়ে বন্ধ, নি:সন্তান, জায়গা জমি নিয়ে ঝামেলা,পারিবারিক অশান্তি দূর করা, অসাধ্য সাধন, জিন-পরির আসর থেকে রক্ষাসহ সব বিষয়ে সেবা ও সু-পরমর্শ দেন তারা। আগে বিভিন্ন নামে সর্বরোগের এসব চিকিৎসক মানুষের বসত-বাড়ি ও ভবনের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাটানোর কাজ করলে তারা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুস্টিং এর মাধ্যমে প্রচার, এমনকি জনপ্রিয় ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি বাংলায়, আবার কখনও ডিস ক্যাবল অপরেটরের মাধ্যমে এসব প্রচার করছে।
দেশের বিভিন্ন জেলার হাট,বাজার এর পাশাপাশি তারা স্কুল, কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আকৃষ্ট করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আশে পাশে সব চেয়ে বেশি লিফলেট বিতরণ ও পোস্টারিং করে থাকে। স্কুলে সন্তানদের আনা নেওয়ার সময় এসব অশ্লিল পোস্টার দেখে অনেক অভিবাবক লজ্জায় পড়েন, আর কোমলমতি শিক্ষার্ত্রীরা পড়েন বিভ্রান্তিতে।
এই ব্যাপারে বান্দরবান শহরের এক শিক্ষার্ত্রী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পৌর এলাকায় এসব অপ চিকিৎসার পোস্টার লাগানো হলেও এই বিষয়ে পৌরসভাসহ প্রশাসনের কোন পদক্ষেপ দেখা যায়না।
উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে তথ্য সম্প্রচার আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এভাবেই প্রচারিত হয় প্রতারণামূলক টিভি বিজ্ঞাপন। এদেশের দর্শকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল জি বাংলায় প্রতিদিন নিয়ম করে দেখানো হয় এসব অশ্লীল বিজ্ঞাপন। যা একদিকে দেশের সন্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে টিভি দেখা যেন এখন লজ্জার বিষয়।
চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন দেশের অসংখ্য অসচেতন মানুষ। জি বাংলার মতোই সনি আটের একটি বিজ্ঞাপনে গানের সুরে সুরে আল্লাহ বরকত লকেট নামের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধানের বার্তা দেয়া হয় দর্শকদের। আবার কখনো ভারতের কামরুপ কামাক্ষার তান্ত্রিক হিসাবে পরিচয় দিয়ে সর্বরোগের সমাধানের বার্তা দেওয়া হয়।
জি নিউজে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের গুরুজী (প্রতারক) বলেন, বিজ্ঞাপন প্রচারের অনুমোদন না থাকলে এত বড় ভিআইপি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার করে বান্দরবানে রাজত্ব করতে পারতাম?
অনুসন্ধানে জানা যায়, জি বাংলার প্রতারণা মূলক বিজ্ঞাপনে প্রচারিত একটি নাম্বার (০১৭৮৩৪৯১৬৯৭)। ফোনটি ব্যবহারকারি রাসেল সাধু বাবার খেদমতগার পরিচয় দিলেও তার আসল নাম জুয়েল খান, সে টাঙ্গাইল সৃস্টি একাডেমির শিক্ষার্ত্রী এবং টাঙ্গাইলের বাসিন্দা হলেও বান্দরবানের বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে এই অপরাধ করে যাচ্ছে। অঞ্জলি চাকমা (০১৮৯০১১৮১৫২) তিনি ভারত থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে এসে নিজেকে বৈদ্য বলে পরিচয় দিয়ে দেয়ালে সাটানো পোস্টারে বান্দরবান শহরের বালাঘাটা এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করলেও তার প্রকৃত নাম অঞ্জলি রাণী, বালাঘাটায় তার কোন হদিস পাওয়া না গেলেও শুধু মোবাইল নাম্বারকে অবলম্বন করে করছে রমরমা বাণিজ্য।
এই ব্যাপারে বান্দরবান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই ধরণের অপচিকিৎসা কেউ করছে অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
আরো জানা গেছে, দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে বান্দরবান,রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পাহাড়ী এলাকার মানুষদের তন্ত্র-মন্ত্রের জন্য পারদর্শী ভেবে বিশ্বাস করে বসে, আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রতারকরা পার্বত্য জেলার বাসিন্দা পরিচয়ে মগ বৈদ্য, তান্ত্রিক সম্রাট, পাহাড়ের তান্ত্রিক গুরু, গুরামাতা’সহ বিভিন্ন পরিচয়ে সারাদেশে লিফলেট বিতরণ ও পোস্টারিং করে সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে চিকিৎসা ও যাদু-টোনার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এসব ফাঁদে পড়ছে দেশের অশিক্ষিত শ্রেণি থেকে উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ।
এই ধরণের এক অপ চিকিৎসক আফরোজা বেগম, এই কবিরাজের ঠিকানা রাঙামাটি জেলার শুভলং এলাকায় বলা হলেও তার পোস্টারে ০১৮৮১০২৪২৩৪ নাম্বারটি ব্যবহার করলেও এই নাম্বারটির মালিক শিপন কবিরাজ, সে রাঙামাটি জেলার বাসিন্দা নন।
এই ব্যাপারে বান্দরবানের সিভিল সার্জন অং সুই প্রু মার্মা বলেন, এসব অপচিকিৎসা করা করছে তা বের করতে আমরা জেলা প্রশাসকের সাথে বসবো, আর এই ব্যাপারে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
স্থানীয়রা মনে করছে, দ্রুত এসব ভূয়া বৈদ্য, কবিরাজ, তান্ত্রিকদের অপ চিকিৎসার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করলে প্রতারণার হাত থেকে মুক্তি পাবে সাধারণ মানুষ।