বান্দরবান পার্বত্য জেলার পাহাড় জুঁড়ে জুমের ধানে সবুজ পাহাড় এখন সোনালি রুপ ধারন করেছে। পাহাড়ের ভূমিতে এই জুমকে ঘিরে যাদের স্বপ্ন, পাহাড়ের চিরচারিত প্রথা জুম চাষাবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য আদিবাসীদের এতো সংগ্রাম- সংঘাত। সেই জুম পাহাড়ের জুমের পাকা ধানে আদিবাসীদের চোখে মুখে এনে দিয়েছে হাসির ঝিলিক।
জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য জেলার জুম পাহাড় থেকে এখন ফসল তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে স্থানীয় আদিবাসীরা। এবারে বান্দরবানের ৭টি উপজেলায় ৯ হাজার ৮৮৮ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে জুম চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধান। জেলার ১৫ হাজার ১৩৮ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি পরিবার এ চাষের সঙ্গে জড়িত। গতবারে এ চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে।
সরজমিনে জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার লাপ্পাই মুখ এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, পাহাড়ে পাহাড়ে টং ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করা আদিবাসীরা পাহাড় থেকে থুরুম (ঝুঁড়ি) ভরে ধান সংগ্রহ করছে। আর একই পরিবারের কেউ কেউ এই ধান স্তুপ করে রাখছে টং ঘরে।
জেলার মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, লুসাই, পাংখো, বম, চাকসহ ১১টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকাংশরাই জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। জুমের উৎপাদিত ধান থেকে বছরের ১২ মাসের অন্তুত ৮ মাস তারা খাদ্যের জোগান মজুদ করে আদিবাসীরা। তিন পার্বত্য জেলার আদিবাসীরা প্রতিবছর জেলার বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাহাড়ে জুম চাষ করে আর এর ব্যতিক্রম হয়নি এবারও।
রোয়াংছড়ির লাপ্পইমুখ এলাকার হ্লাচিং মার্মা বলেন, বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দিয়ে চাষাবাদে প্রস্তুত করে পাহাড়ের গায়ে গর্ত খুঁড়ে ধানের বীজ বোনেন। একই সাথে সাথী ফসল হিসেবে বোনা হয় মরিচ, ভুট্টাসহ নানা জাতের শাকসবজির বীজও।
তিনি আরো বলেন, চার মাসের কঠোর পরিশ্রমে ধীরে ধীরে জুমের ক্ষেতগুলো ভরে ওঠে সোনালী ধানে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাহাড়ে জুমের ধান কাটা শুরু করে তারা। এই জুম ধান কাটাকে কেন্দ্র করে আদিবাসী বম সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন সম্প্রদায় পাহাড়ের দূর পল্লীতে আনন্দ-উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে উঠে, অনেকে মিলিত হয় প্রার্থনায়।
লামা উপজেলার রুপসীপাড়ার আলিয়াং বাবু পাড়া কারবারী নথিরাম জানায়, এবার তিনি ১৮ হাজার টাকা খরচ করে ৪ একর পাহাড়ে জুম চাষ করেছেন। জুমে ইদুর কিংবা শুকরের আক্রমণ না হওয়ায় ৩০০ আড়ি ধান ঘরে তোলার পাশাপাশি প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকার তিল, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া ও বেগুন বিক্রি করেছেন।
ফসল ঘরে তোলার এই সময়টা পাহাড়ের জুমিয়ারা নবান্ন উৎসব হিসেবে পালন করেন। তারা রাতে নাচ, গান, সংস্কৃতির অংশ হিসেবে শূকর মেরে মদ্যপানসহ পালন করে নানা অনুষ্ঠান। মহানন্দে জুমিয়া পরিবারগুলো আগামী বছর আরও বেশি ফসল পাওয়ার আশায় দেবতাকে পূজা দেওয়ার পর জুমের প্রথম ভাত মুখে তুলে নিচ্ছেন।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিরা জুমে ধানের পাশাপাশি ভূট্টা, মরিচ, যব, সরিষা, মিষ্টি ও চাল কুমড়া, চিনার, বেগুন, কাকন ধান, মারপা, তিল, পুঁই ও টকপাতাসহ হরেক রকমের শাক সবজি চাষ করেছেন। পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার জুমে রেকর্ড পরিমাণ জুম চাষ হয়েছে।
লামা উপজেলার টংকাবতি ইউনিয়নের চাষী মেনরত ¤্রাে বলেন, ইদুর বন্যা, জুম ক্ষেতে বন্যহাতি ও বন্য শুকরের আক্রমন থাকলেও রোগবালাইয়ের আক্রমন কম ছিল, এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় এবং তেমন রোগবালাই না হওয়ায় এবার ফসল ভালো হয়েছে।
মাত্র কয়েকমাস আগেও যেসব পাহাড় সবুজে সবুজে ঢাকা ছিলো, এখন সেখানে পাকা ধানের সোনালী হাসি। কেউ কাটছে পাকা ধান, আবার কেউ কাটার প্রতিক্ষা গুনছেন। আর এই জুমের ধান থেকে একদিকে খাদ্যের জোগান, অন্যদিকে বছর জুঁড়ে অর্থনৈতিক ভাবে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখছে এখন পাহাড়ের আদিবাসী সম্প্রদায়।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ সহকারী পরিচালক ভবতোষ চক্রবর্তী বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় এবার বান্দরবানের ৭টি উপজেলার পাহাড়গুলোতে জুমের ফলন ভালো হয়েছে।