দেশের জন্য সম্মান অর্জনেই অপরাধ, আমাকে বাচঁতে দিন
“আমি আমার শিক্ষকতার মাধ্যমে অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের শিক্ষার জন্য সম্মান অর্জন করেছি কিন্তু এই সম্মানেই এখন আমার জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে, আমাকে বাচঁতে দিন”। এমন আকুতি জানিয়ে বলছিলেন বান্দরবানের এক সহকারী শিক্ষিকা জয়নব আরা বেগম।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে তিনি চাকুরীতে প্রবেশ করলেও ২০১০ সালে ২৫ এপ্রিল জেলার আলীকদম চম্পট পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। এরপর তিলে তিলে নিজের মেধা ও পরিশ্রমে দেশের জন্য বয়ে আনেন একের পর এক সম্মান। কিন্তু তাতে বাদ সাধে প্রতিষ্ঠানটির দুই শিক্ষক ও উপজেলা চেয়ারম্যান। সামাজিক ভাবে সম্মানহানী, হয়রানি,এমন কোন কাজ নেই যা করেনি তারা, জয়নবের জীবনকে করছে ঝুঁকিপূর্ন ও স্বপ্নহীন।
আরো জানা গেছে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগীতায় ও সরকারের অনুমতি ক্রমে “গ্লোবাল লার্নিং” এর উপর স্কুলস অনলাইন পার্টনারশীপ ইংল্যান্ডের স্কটস প্রাইমারি স্কুলে ভিজিট কালীন সময়ে তিনি দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে উপস্থাপন করেন। আর তাতে সন্তুষ্ট হয়ে ইংল্যান্ডের মেয়র ভবনে গত ১৯ শে জুলায় জয়নবকে রানীর পোশাকে সজ্জ্বিত করে এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। যা ইংল্যান্ডের তিনটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ এমপি বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ ছিদ্দিকির সাথে সাক্ষাত করানোর জন্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে নিয়ে যাওয়া হলে, সেখানে স্পিকারের চেয়ারে বসিয়ে সম্মান জানানো হয়। ব্রিটিশ কাউন্সিলের আয়োজনে ১৭টি দেশের ভাষার গান নিয়ে “ওয়ার্ল্ড ভয়েজ” প্রোগ্রামের তিনি একজন এ্যাম্বাসেডর।এ সম্মানের পর স্থানীয় প্রশাসন তাকে বাড়িতে গিয়ে সম্মান জানায়। বাংলাদেশ-কোরিয়ার উদ্যোগে আয়োজিত কারিকুলাম ডেভেলপমেন্টের কর্মশালায় অংশগ্রহনের জন্য এনসিটিবি চেয়ারম্যান ও কোরিয়ান গণিত ও বিজ্ঞান স্পেশালিস্ট টিম প্রশংসাপত্র প্রদান ও চারবারের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয় তিনি। দেশের ৬৪ জেলা থেকে মাত্র দুই স্কুল শিক্ষককে “টিচারস কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট”(টিকিউআই) প্রশিক্ষক নির্বাচিত করা হয়, তার মধ্যে তিনি একজন।
আরো জানা গেছে, শিক্ষক বাতায়ন পোর্টালে সক্রিয় শিক্ষকের মধ্যে ২য় অবস্থানে থাকা জয়নবের স্কুলটি এখন” ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যাওয়ার্ড” পাওয়ার জন্য আবেদন করার জন্য নির্বাচিত স্কুল। ২০১৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছ থেকে মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্টের উপর “সেরা শিক্ষক” এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত হন। এতো অর্জনের পর ক্লাসে উপকরণ ব্যবহার, মাল্টি মিডিয়া ক্লাস নেওয়া,স্কুল সজ্জ্বিতকরণ, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণে সম্মানিত হওয়ায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্ষোধ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জয়নবের বিরুদ্ধে মাঠে নামে।
জয়নব অভিযোগ করে বলেন, স্কুলের প্রধান শিক্ষক হুমায়রা বেগম ও সহকারী শিক্ষক নুরুল আজিম এলাকায় প্রচার করেন আমার এসব অর্জন শিক্ষামন্ত্রী এবং লন্ডনের মেয়রের সাথে নষ্টামী করে পেয়েছি।
নিজ স্কুলে ল্যাপটপ থাকার পরও ব্যবহার করতে না পারায় কিস্তির অর্থে ল্যাপটপ কিনে নেট ব্যবহার করে দেশকে ও নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তিনি সম্মান এনে দেন।
তিনি আরো বলেন, মাল্টিমিড়িয়া ক্লাস করতে ল্যাপটপ ব্যবহার করেন বলে প্রধান শিক্ষক হুমায়রা বলেন, “তুই যদি আর স্কুলে ল্যাপটপ ব্যবহার করিস তাহলে তোকে জুতা দিয়ে পিটাবো।”
দশ বছর ধরে একই বিদ্যালয়ে দায়িত্বে থাকা অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক হুমায়রা বেগম বলেন, আমি এই ধরণের কোন কাজ করিনি, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা।
শুধু এখানেই শেষ নয়, গত ২৮ মার্চ রাত নয়টার গাড়িতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের “প্রফেশনাল ডেভলাপমেন্ট কোর স্কিল” এ অংশগ্রহণ করতে ঢাকা যাচ্ছিলেন তিনি। এসময় আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম “সিরাজুল ইসলাম” ছদ্মনাম ধারণ করে কক্সবাজারের চকরিয়া থানা পুলিশকে অবহিত করে বলেন, জয়নব অন্যের সাথে পালিয়ে যাচ্ছেন। এসময় চকরিয়া থানার এস আই মাহির উদ্দিন খান উজ্জল তাকে আটক করে লাঞ্চিত করে, পরে ছেড়ে দেয় তাকে।
আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন,আমি শিক্ষা কমিঠির সভাপতি, উনার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের অভিযোগ আছে, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন।
স্থানীয়রা মনে করেন,এই ব্যাপারে তদন্ত্র পূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে শিক্ষক জয়নবের মতো শত মেধাবী জয়নবের দেশের জন্য কিছু অর্জন করার স্বপ্ন হারিয়ে যাবে, অন্যদিকে দেশে আধুনিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গতি হারাবে।
বান্দরবান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল কাদের বলেন, বিষয়টি তদন্ত্র করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অভিযোগ প্রমানিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।