বান্দরবানের সেই প্রতারক নেতা প্রিন্স সেন’কে কারাগারে প্রেরণ

NewsDetails_01

প্রিন্স সেন
বান্দরবান পার্বত্য জেলার তরুণ লীগের আহবায়ক, প্রতারক নেতা প্রিন্স সেনকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান করেছে আদালত। হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তিনি আজ সোমবার দুপুরে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আত্মসমার্পন করে জামিন চাইলে আদালত জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান করে। গত ৩ অক্টোবর বান্দরবান সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা একটি মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয় বলে বান্দরবানের আইনজীবি কৌশিক দত্ত পাহাড়বার্তাকে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের দূর্দিনে কখনও তাকে মাঠে দেখা না গেলেও সংগঠনের নাম বিক্রি করে ক্ষমতার প্রভাবে নারী নির্যাতন, চাকরী দেবার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া, হুমকি-ধমকি, ইয়াবা ব্যবসা, হীন কোন কাজ নেই যা তিনি করেননি। ক্ষোধ পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী ও পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নাম ভাঙ্গিয়ে, আর কখনও তরুণ লীগের নেতা, কখনও হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা, আবার কখনওবা সামাজ সেবক সেজে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন নিত্য নতুন কায়দায় প্রতারণার নজির গড়েছেন তিনি আলোচিত হয়েছেন।
►► শুরু কথা
প্রিন্স সেন, পিতা তরনী সেন, মাতার নাম বিঝু রাণী সেন, পরিচয় লুকাতে পিতার নাম বলেন, রতন কান্তি সেন। আদিনিবাস ভোলা জেলার তমিজুদ্দিন থানায়। বর্তমানে জেলা শহরের ক্যাচিংঘাটায় বসবাস করেন তিনি। বান্দরবান শহরের সুইচ গেইট এলাকায় একটি ছোট ঔষুদের দোকানে কাটতো তার অলস সময়, থাকতেন ভাড়া বাসায়। ২০১০ সালের ১০ মার্চ শহরের বাজার এলাকার সু-পরিচিত রঞ্জিত দাশ এর কন্যা রুপা দাশকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে বিয়ে করেন। এরপর থেকে যৌতুকের দাবিতে বিভিন্ন সময় নির্যাতন করতে থাকে। ২০১১ সালে শহরের বনরুপা এলাকার ভাড়া বাসায় নিজের স্ত্রীকে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে হত্যার চেষ্টা অভিযোগে মামলায় তিনি ৯ মাস কারা ভোগ করেন,এরপর জামিন নিয়ে বের হন।
এরপরও থেমে থাকেনি তিনি, ফের প্রতারণাসহ নেশা গ্রহন করে প্রতিনিয়ত স্ত্রীকে নির্যাতন অব্যাহত রাখেন, আর এ নিয়ে ক্ষোধ পৌর মেয়র ইসলাম বেবী, বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক সিনিয়র নেতা অন্তত ২৫বার বিচার-সালিশ করেন। রুপা-প্রিন্সের কোল জুঁড়ে এক সন্তান আসার পরও থেমে থাকেনি নির্যাতন। প্রথম সন্তানের জন্মদিন পালন করেন রাজকিয় ভাবে, শহরের আর্মি কেন্টিনে। উপস্থিত ছিলেন জেলার শীর্ষ রাজনীতিবীদসহ থেকে শুরু করে তৎকালীন জেলা প্রশাসক। তিনি সেই অনুষ্ঠানের সব ছবি তুলে রাখেন, বান্দরবানের অন্যতম শ্রদ্ধাভাজনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ধারণ করা এসব ছবি সহজ সরল মানুষের কাছে উপস্থাপন করেন আর প্রভাবশালীদের সাথে সচিত্র এসব ছবি ব্যবহার করে একে একে ফাঁদ পাতেন নিত্য নতুন অপরাধের, মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লক্ষ লক্ষ টাকা।
►►প্রিন্সের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
গত ৫ মে জেলা শহরের ইস্টেডিয়াম এলাকার বৃদ্ধা রানু ধরকে মেরে রক্তাক্ত করেন, আর এই ঘটনা নিয়ে রানু ধর বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন বান্দরবান পৌরশাখার সভানেত্রী নীলিমা আক্তার নীলাকে অবহিত করা হয়। এই ঘটনার বিষয়ে এই মানবাধিকার নেত্রী প্রিন্সের সাথে যোগাযোগ করলে নীলিমা আক্তার নীলাকে ঘটনা বেশি দূর না নিতে ফোনে শাসান বলে এই মানবাধিকার নেত্রী তার ফেসবুক ওয়ালে প্রকাশ করেন।
বান্দরবান সদরের কুহালং ইউনিয়নের চড়ূইপাড়ার বাসিন্দা গরা মং মার্মা অভিযোগ করেন, গতবছর তার মেয়েকে পুলিশ বাহিনীর কম্পিউটার অপারটের হিসাবে চাকরী প্রদান করবে বলে তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। তিনি আরো বলেন, প্রিন্স একজন খারাপ লোক ও প্রতারক।
২০১৭ সালে শহরের কালাঘাটা এলাকার ব্যবসায়ি মহরম আলীর স্বজনকে চাকরী দেওয়ার কথা বলে তিনি তার কাছ থেকে ২ লক্ষটাকা হাতিয়ে নেন। একই বছর জেলার আলীকদম উপজেলার ছাত্রনেতা অং শো থোয়াইয়ের কাছ থেকে চাকরী দেবার নামে কয়েক লক্ষ টাকা এবং লামা উপজেলার আজিজনগরের এক বাসিন্দা থেকে একই প্রতিশ্রুতি প্রদান করে দুই লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
গতবছর রোয়াংছড়ির এক আদিবাসীকে চাকরী প্রদানের আশ্বাস প্রদান করে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ঘটনার সাথে শহরের মধ্যমপাড়ার বাসিন্দা মংসিং হাইকে জড়িয়ে ফেলে। ভুক্তোভোগি এই ঘটনাটি ক্ষোধ পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীকে অবহিত করলে প্রতিমন্ত্রী প্রিন্স সেনকে অর্থ পরিশোধের পাশাপাশি সাবধান করে দেন। সর্বশেষ গত ৩ সেপ্টেম্বর শহরের ক্যাউচিংঘাটায় ১০ লক্ষ টাকা যৌতুকের দাবীতে নিজের স্ত্রীকে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করে, আঘাত করে মাথায়। একপর্যায়ে তার ভাই রাজেশ দাশ বোনকে উদ্ধার করে মূমর্ষ অবস্থায় সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। এই ব্যাপারে একইদিন সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এসব তথ্য অনুসন্ধানে পাওয়া, এর বাইরে আরো অনেক অভিযোগের ফিরিস্থি আছে তা যেন শেষ হবার নয়।
তবে এই ব্যাপারে অভিযুক্ত প্রিন্স সেন বলেন, আমি কারো নাম ব্যবহার করে কারো কাছ থেকে অর্থ আদায় করিনি, যা সমস্যা ছিলো তা শেষ হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমার রাজনৈতিক শত্রুরা এসব অপপ্রচার চালায় আমাকে ঘায়েল করতে। আমি ভালো না হলে বিভিন্ন সংগঠনের এতগুলো পদে থাকতে পারতাম না।
এই ব্যাপারে বান্দরবান সদর থানার এসআই অজয় দেবসহ আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, প্রিন্স সেনের বিরুদ্ধে আগেরও অনেক অভিযোগ আছে, কয়েকদিন আগেও একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে।
►► সাংগঠনিক ভাবে তিনি সত্যি কি নেতা !
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে স্বীকৃত সাতটি সহযোগী ও দুটি ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন রয়েছে। সহযোগী সংগঠনগুলো হচ্ছে- যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও তাঁতী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন হলো ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ। দলের গঠনতন্ত্রে এর বাইরে কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। বাকি সবগুলো ভুঁইফোড় সংগঠন, সেই হিসাবে তরুণ লীগ ভুঁইফোড় সংগঠন।
গত ১০ বছর আগেও এই নেতাকে কখনও মিছিল মিটিং এ দেখা না গেলেও আওয়ামী লীগের টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে দুই মেয়াদের চলতি মেয়াদে কেবল তরুণ লীগের নাম ব্যবহার করে ‘সংগঠন বাণিজ্য’ করেই তিনি জেলার ৭টি উপজেলায় প্রতারণার জাল পাতেন। আর তাকে রাজনৈতিক শেল্টার দেবার অভিযোগের তীর সেচ্ছাসেবকলীগের বান্দরবানস্থ কেন্দ্রিয় নেতার বিরুদ্ধে। আর এই প্রতারণার জালে অনেকে নি:স্ব হয়েছেন আর তিনি হয়েছেন শহরের ক্যাচিংঘাটা এলাকায় পাকা বাড়ির মালিক, জেলা শহর দাবড়িয়ে বেড়ান দামী মোটরবাইক নিয়ে।
আওয়ামী লীগের এই সংগঠন আর ক্ষোধ জেলার শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সম্পর্ক আছে, উনার পারিবারিক অনুষ্ঠানে শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকেন, এমন ছবি লোকজনকে দেখিয়ে চাকরী দিতে পারবেন এমন আশ্বাস দিয়ে জেলার লামার আজিজনগর, রোয়াংছড়ি উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২০জন থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন। ফলে মূল সংগঠন ও সরকার তথা ক্ষোধ পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী ও পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে, এমন অভিমত স্থানীয়দের।
►► প্রিন্স সেন এর যত পদবি
প্রিন্স সেন এর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে জানা যায়, তিনি বর্তমানে ১০টি বিভিন্ন সংগঠনের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে আছেন। জেনে নিন উনার তথাকতিথ কর্মতৎপরতা।
প্রাথমিক/সদস্য.বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-বান্দরবান, আহবায়ক, বাংলাদেশ আওয়ামী তরুণ লীগ, বান্দরবান। আহবায়ক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ বান্দরবান, সভাপতি,বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট বান্দরবান, সভাপতি,জ্যোতিশ্বর গীতা শিক্ষা সংঘ (জ্যোগীশিক)বান্দরবান, পরিচালক,জ্যোতির্ময় গীতা শিক্ষা ও সঙ্গীত একাডেমী,কক্সবাজার,উপদেষ্টা,কক্সবাজার সনাতনী বার্তা,কক্সবাজার, উপদেষ্টা,কেন্দ্রীয় সৎ সংঘ বিহার,মেঘলা, বান্দরবান,উপদেষ্টা,মাসিক জ্যোতির্ময় পত্রিকা, কক্সবাজার, সা:যু:আহবায়ক,বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগ বান্দরবান,পরিচালক,জ্যোতির্ময় গীতা শিক্ষা ও সংগীত একাডেমী কক্সবাজার এবং তিনি ডাক্তার হিসাবে হাসপাতালও মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত ছিলেন।

আরও পড়ুন