বান্দরবানে ওয়ার্ল্ড ভিশন ও বিএনকেএস এর ত্রাণ বিতরণে নয়ছয়
বান্দরবানে চলতি বছরের জুলাই মাসে ১২দিনের টানা বর্ষণে ঘরবাড়ি ডুবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় পৌর এলাকার প্রায় ২ হাজারের ও বেশি পরিবার। আর এসব ক্ষতিগ্রস্থদের ত্রাণ সহায়তা দেবার নামে ওয়ার্ল্ড ভিশন ও বলীপাড়া নারী কল্যাণ সমিতি (বিএনকেএস) ছবি আইডি কার্ড এবং তালিকায় স্বাক্ষর নিয়ে কয়েকজন কম ক্ষতিগ্রস্থ স্বচ্ছল পরিবারকে ত্রাণ দিলেও কোন ত্রাণ সহায়তা পায়নি পৌর এলাকার ছবি ও আইডি কার্ড নেয়া প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় পরিবারগুলো। বান্দরবানের ৯টি ওয়ার্ডের ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের লোকজনেরা এসব অভিযোগ তুলেন।
জানা গেছে,বান্দরবানে চলতি বছরের জুলাই মাসের ৬ তারিখ (শনিবার) থেকে ১৫ তারিখ (সোমবার) পর্যন্ত টানা ১২দিন চলে বর্ষণ। আর এ বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের ২ হাজারেরও বেশি পরিবার। এদের মধ্যে যাছাই বাছাইয়ের মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড ভিশন ও বলীপাড়া নারী কল্যাণ সমিতি (বিএনকেএস) স্টার্ট ফান্ড ও ইউকেএইড এর আর্থিক সহায়তায় পৌর এলাকার প্রতি ওয়ার্ড থেকে অধিক ক্ষতিগ্রস্থ ৬০ পরিবার করে ৯টি ওয়ার্ডে ৫শ ৪০ পরিবারকে জনপ্রতি নগদ ৫হাজার ৫শ টাকা, সাবান, ডেটল, বালতিসহ নানা ত্রাণ সামগ্রী দেয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ,ওয়ার্ল্ড ভিশন ও বলীপাড়া নারী কল্যাণ সমিতি (বিএনকেএস) প্রতি ওয়ার্ডে ৬০ জন করে ৯টি ওয়ার্ডে ৫শ ৪০ জনকে ত্রাণ সহায়তা দেবার কথা বলে ছবি, আইডি কার্ড ও একটি তালিকায় স্বাক্ষর নেয়। কিন্তু ত্রাণ বিতরণের সময় হাতে গোনা কয়েকটি স্বচ্ছল পরিবারকে ত্রাণ দেয়। এমনকি একই পরিবারের কয়েকজনকেও দেয়া হয় ত্রাণ। আর তাদের এ অনিয়মের কারণে বঞ্চিত হয়েছে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা।
পৌর কাউন্সিলরদের অভিযোগ, ওয়ার্ল্ড ভিশন ও বিএনকেএস এ দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের প্রতিটি ওয়ার্ডে ৬০জন বন্যার্ত পরিবারকে সহায়তার কথা বলে তাদের কাছ থেকে যে তালিকা নিয়েছিল সে তালিকা অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণ না করে নিজেদের তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী ত্রাণ সরবরাহ করেছে। তবে কাদের সরবরাহ করেছে তাও জানেন না তারা।
তারা আরো বলেন, প্রতি ওয়ার্ডে ৬০ জন করে ৫শ ৪০ জনের যে তালিকা তারা করেছে সেখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকজন প্রভাবশালী ও হাতেগোনা কয়েকজন দুস্থ পরিবারের মাঝে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করলেও তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্থরাই কোন সহায়তা পায়নি।
বান্দরবান শহরের ইসলামপুরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ বাসিন্দা মোঃ আবুল কাসেম, শামসুন নাহার, ইয়াসমিন আক্তারসহ কয়েকজন বলেন,বন্যায় আমাদের ঘরবাড়ি একদম ভেঙ্গে গেছে। ওয়ার্ল্ড ভিশন ও বিএনকেএস থেকে কয়েকজন এসে আমাদের কাছ থেকে ত্রাণ দিবে বলে ছবি, আইডি কার্ড ও একটি তালিকায় স্বাক্ষর নিল। যখন ত্রাণ দিচ্ছে তখন জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে আপনাদের পরে দেয়া হবে কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমরা কিছুই পেলাম না।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ সুফিয়া বেগম ও খুরশিদা বেগম বলেন, একই ঘরের দুই তিনজনও ত্রাণ পেয়েছে। আবার যারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি তারাও পেয়েছে। কিন্তু আমরা ছবি,আইডি কার্ড জমা দেবার পরও কিছুই পেলাম না। কিছু না দিলে আমাদের ছবি, আইডি কার্ড ও স্বাক্ষর কেন নিল?
এ বিষয়ে কথা হয় ১,২ ও ৩নং ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর উজালা তঞ্চঙ্গ্যা এবং ৭,৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর রাহিমা বেগমের সাথে । তারা জানান, পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের ৩জন মহিলা কাউন্সিলারের কাউকেই ওয়ার্ল্ড ভিশন ও বিএনকেএস এর ত্রাণ সহায়তার ব্যাপারে জানানো হয়নি। তারা কাদের সহায়তা দিয়েছে সে বিষয়ে কিছুই জানেননা তারা।
এ বিষয়ে ২নং ওয়ার্ডের পৌর কাউন্সিলর মোঃ আলী বলেন, আমার ওয়ার্ডে ওয়ার্ল্ড ভিশন ও বিএনকেএস ৬০ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেবার কথা ছিল। সে অনুযায়ী আমি তালিকাও দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার তালিকা অনুযায়ী কাউকেই কোন ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়নি। তারা কাদের দিয়েছে তাও আমাকে জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ভিশন বান্দরবানের প্রোগ্রাম অফিসার যোসেফ ত্রিপুরা বলেন,আমরা বিএনকেএস এর সাথে যৌথভাবে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছি। যাদের দিয়েছি তাদের কোন তথ্য এবং নামের তালিকা আমাদের কাছে নাই। সবই বিএনকেএস এর কাছে রয়েছে।
এ বিষয়ে বান্দরবান বিএনকেএস এর নির্বাহী পরিচালক হ্লা সিং নু মারমা বলেন, মানুষের তালিকা করতে গেলে একটু ভুল হতেই পারে, দু’একজন প্রভাবশালীও পেতে পারে। ৫শ ৪০জনের মধ্যে একটু এদিক সেদিক হয়েছে তা অস্বীকার করছিনা।
বান্দরবান পৌরসভার প্যানেল মেয়র দিলীপ বড়ুয়া বলেন, বিএনকেএস ও ওয়ার্ল্ড ভিশনকে আমরা একটি তালিকা দিয়েছিলাম কিন্তু তারা আমাদের তালিকা বাদ দিয়ে নিজেদের তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী ত্রাণ দিয়েছে। কাদের দিয়েছে তা আমাদের জানায়নি।
তিনি আরো বলেন, গত ১৬ আগস্ট বান্দরবান পৌরসভায় মেয়রের উপস্থিতিতে ত্রাণ দেবার কথা থাকলেও কোন এক অজানা কারনে পৌরসভায় ত্রাণ বিতরণ না করে নির্ধারিত তারিখের ৬ দিন আগে ১০আগস্ট মেয়রকে না জানিয়ে ওয়ার্ল্ড ভিশনের মাঠে ত্রাণ বিতরণ করে ফেলে। এতে মেয়রসহ আমরা সবাই অপমান বোধ করেছি ।
তিনি আরো বলেন,৫শ ৪০ জনকে ত্রাণ দেবার কথা থাকলেও তার অর্ধেক মানুষকে দেয়া হয়েছে কিনা তাতে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। ঘটনাটি অবশ্যই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদন্ত করে দেখা উচিত।
এ বিষয়ে বান্দরবান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নোমান হোসেন প্রিন্স বলেন, এ বিষয়ে আমি এখনো কোন লিখিত অভিযোগ পাইনি,তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।
প্রসঙ্গত,সম্প্রতি বান্দরবানের কিছু প্রভাবশালী এনজিও স্থানীয় প্রশাসনকে এড়িয়ে তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করে যাচ্ছে । তাদের কাজের কোন তদারকি না থাকায় এত কাজ করার পরও পাহাড়ের অসহায় মানুষের জীবনযাত্রার মানের কোন উন্নতি হচ্ছেনা । বান্দরবানের সকল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উন্নয়ন কাজ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিবে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ,এমনটাই দাবি স্থানীয়দের।