বান্দরবানে নিষিদ্ধ টমটমের রাজত্ব : পুলিশের গাড়ি ২৮ টি
সারাদেশে তিন চাকার টমটম বা ইজিবাইক নিষিদ্ধ থাকলেও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় যেন বৈধ। বিদ্যুত অপচয়কারী ব্যাটারী চালিত এই অটো রিক্সার দৌরাত্ম্য প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট বড় দূর্ঘটনা, ফলে প্রান হারানোর পাশাপাশি অনেকে পঙ্গুত্ব বরন করছে। এই প্রান হারানোর যান নিয়ে স্থানীয়রা ক্ষুদ্ধ হলে ও নীরব প্রশাসন। আর এ নিয়ে এস বাসু দাশ এবং ইয়াছিনুল হাকিম চৌধুরীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১ হাজারেরও বেশি টমটম গাড়ি রাস্তায় চলাচল করলে ও নেই কোন বৈধ কাগজপত্র। জেলা শহরেই আছে অন্তত ৩শ অবৈধ টমটম। আর এসব টমটম এর মালিকানা ক্ষোদ পুলিশের অনেক সদস্য হওয়ার কারন, অন্যদিকে অধিকাংশ চালকই অদক্ষ আর অপ্রশিক্ষিত, ফলে এই যানবাহন দূর্ঘটনার কারন হলেও এসব টমটমের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বান্দরবান কালেক্টরেট স্কুলের নৃত্য শিক্ষক পিংকি দাশ বলেন, টমটমের কারণে আমরা অতিষ্ঠ, কিছুদিন আগে আমাদের সরকারী বালিকা স্কুলে এক শিক্ষিকা,পুলিশ সদস্যের স্ত্রীসহ বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন ঘটছে দূর্ঘটনা, কেউ কেউ বরণ করছে পঙ্গুত্ব।
আরো জানা গেছে, জেলার লামা,রোয়াংছড়ি, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পুলিশ সদস্যদের কয়টি টমটম আছে জানা না গেলেও বান্দরবান শহরে পুলিশের আছে মোট ২৮টি টমটম।
পাহাড়বার্তা’র অনুসন্ধানে জানা যায়, বান্দরবান সদর এসপি সার্কেল এর ড্রাইভার মুনির এর টমটম গাড়ি নং ২৬৮, ৫৯, ২৭২, ২৮৭সহ মোট ৭টি,পুলিশ সদস্য বশির এর টমটম গাড়ি নং ৬৭ ও ১৪৩সহ ২টি, ডিবিতে কর্মরত রেজাউল করিম এর টমটম গাড়ি নং ২৪০,১৩সহ মোট ৫টি।
একসময় বান্দরবান ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত থাকলে ও বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত পুলিশ সদস্য হালিম এর টমটম গাড়ি নং ১০৭,৮৮,২৭৩সহ ৪টি। বান্দরবান ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ইউসুফ বুখারির ৪টি, বর্তমানে জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত পুলিশ সদস্য আফজাল এর ২টি, হাবিলদার সেলিম এর ২টিসহ মোট ২৮টি।
আরো জানা গেছে,সদর এসপি সার্কেল এর ড্রাইভার মুনির হাফেজ ঘোনা এলাকার বাসস্টেশনে রাস্তার পাশেই গড়ে তুলেছেন টমটম চার্জ দেওয়ার অবৈধ কারখানা। অন্যদিকে ডিবির দায়িত্ব পালন না করে ডিবি রেজাউল জেলা শহরের আওয়ামী লীগ অফিসের নিচের মোবাইল এর দোকানে অবস্থান করে নিজস্ব টমটম এর ভাড়া উত্তোলন করতে ব্যস্ত সময় পার করেন।
বাংলাদেশের বিধান অনুযায়ী একজন সরকারি চাকুরিজীবী ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত থাকা চাকুরিবিধি লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হলেও তারা বছরের পর বছর বান্দরবানের পুলিশ বিভাগে কর্মরত থাকায় নিজ নামে, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নিজ স্ত্রী ও সন্তানদের নামে বা বেনামে পৌরসভা থেকে লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে।
কারিতাস বাংলাদেশের বান্দরবানের কর্মসূচি কর্মকর্তা রুপনা দাশ বলেন, প্রতিদিন জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে টমটম ব্যবহার করি। তারা কি পরিমাণ বেপরোয়া ভাবে গাড়ী চালাই তা বলার ভাষা নেই। আমার ধারণা,তাদের প্রশিক্ষণ নেই, তেমনি নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। তাই তারা ঘটাচ্ছে একের পর এক দূর্ঘটনা।
ব্যাটারী চালিত তিন চাকার বাহনটি বান্দরবানে টমটম নামে পরিচিত। যাত্রী পরিবহণের ক্ষেত্রে এই চাহিদাও কম নয়। শহরের গুরুত্বপূর্ন সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই অবৈধ যানটি। গাড়িগুলোর নেই কোন আইনগত বৈধতা। স্থানীয় টমটম মালিকদের সাথে যোগসাজোশে পৌরসভা কতৃপক্ষ টমটম চলার অনুমোদন দিলেও চালকদের অদক্ষতা আর অনিয়মের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে হতাহতের ঘটনা।
রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ ছাত্র দিপ্ত দাশ বলেন,বান্দরবানে টমটম গাড়ীর কোন ব্যবস্থাপনা নেই। যার ফলে তারা প্রতিদিন বেপরোয়া ভাবে গাড়ী চালাচ্ছে আর সাধারণ মানুষকে ফেলছে দূর্ঘটনার কবলে।
সূত্রে জানা যায়,পর্যটন জেলা বান্দরবানে চাহিদার তুলনায় টমটমের সংখ্যা অনেকাংশে বেড়ে গেছে,তাছাড়া নির্ধারিত ভাড়া অমান্য করে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। অনেকে অভিযোগ করেন, বাজার থেকে ক্যাউচিং ঘাটা এবং হাফেজ ঘোনা যেতে জনপ্রতি ১০ টাকা আবার বাজার থেকে কম দূরত্বের সদর হাসপাতাল ও মেম্বার পাড়া যাত্রী পরিবহণে নেওয়া হয় ১০টাকা। এই ভাড়া নিয়ে বিস্তর অভিযোগ টমটম চালকদের বিরুদ্ধে।
বান্দরবানে সাংস্কৃতিক কর্মী এম.এ মোমেন চৌধুরী বলছেন,টমটম চালকদের কে স্থানীয় প্রশাসন ও বিআরটিএ এর আওতায় এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের অনেক চালক আছে যাদের বয়স মাত্র ১২ থেকে ১৪ বছর। তাদের কিভাবে গাড়ী চালানোর অনুমোদন প্রদান করে তা আমরা বুঝে উঠতে পারছিনা।
২০১২ সালে নিষিদ্ধ করা হলেও যন্ত্রাংশ আমদানির নামে ইজিবাইক আসছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ইজিবাইক বান্দরবানের রাস্তায় নামছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদ অধিবেশনের এক প্রশ্নোত্তর পর্বে বিদ্যুৎ, জালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, বিদ্যুতের অপচয় রোধে সারা দেশে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটো রিকশা স্থানীয়ভাবে সংযোজন নিষিদ্ধ।
বান্দরবানের ইজিবাইক মালিক সমিতির সভাপতি মামুনর রশিদ বলেন, টমটমের ব্যবহারের মাধ্যমে বান্দরবানে স্থানীয় মানুষ ও উপকৃত হচ্ছে। আসলে যারা টমটম চালাই তাদের তেমন একটা শিক্ষাগত জ্ঞান নেই। তাদের ড্রাইভিং লাইন্সেস নাই ঠিক।
তিনি আরো বলেন, তাদের দক্ষতা বাড়ানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। স্থানীয় প্রাশাসন, ট্রাফিক বিভাগের সহযোগিতা পেলে আমরা তাদের দক্ষতা বাড়াতে কাজ করবো।
এদিকে ২০০৭ সালে বান্দরবানে চালু হওয়া এই টমটম গাড়ির এখন অনেকগুলো চলাচলের অনুপযোগী আর জেলার সড়কে শৃংঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপের কথা জানালেন পৌরসভা মেয়র ও জেলা পুলিশ সুপার।
বান্দরবান পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ইসলাম বেবী বলেন, টমটম দিয়ে অবৈধ কিছু মানুষ দুমুঠো ভাত খাচ্ছে এটার জন্যই। আমিও টমটম চাইনা,টমটম বান্দরবানে চলতে দিতে হচ্ছে। আসলে তাদের প্রশিক্ষণ কতটুকু হবে সেটা আমি জানি না, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো যেন জনগণের কোন প্রকার ক্ষতি নাই হয়।
এদিকে বান্দরবানের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, টমটম গাড়ীগুলো দিন দিন বান্দরবানে বাড়ছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, যে যারা টমটম বা অটোরিক্সা চালাচ্ছে তারা অনেকে আগে বান্দরবানে রিক্সা চালাত বা অন্য কোন পেশায় ছিল।
তিনি আরো বলেন, টমটম আমরা পরামর্শ দিয়েছি তারা যেন বিআরটিএ এর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ এবং লাইন্সেস নিয়ে যেন তারা টমটম চালাই।
বর্তমানে বান্দরবান জেলায় ব্যাটারী চালিত এই টমটম গাড়ির সংখ্যা প্রায় ১ হাজার, আর দিন দিন যোগ হচ্ছে আরো নতুন গাড়ী। স্থানীয়দের দাবি ব্যাটারী চালিত এই টমটম গাড়ির মালিক ও চালকদের আরো সচেতন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে কমে আসবে দুর্ঘটনা, হ্রাস পাবে হতাহতের সংখ্যা।