বান্দরবানে রাজনৈতিক ঐক্যে গরু পাচার করে রাতারাতি গাড়ি, বাড়ির মালিক !

অরক্ষিত সীমান্ত

NewsDetails_01

বান্দরবান সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত থাকায় মিয়ানমার থেকে জেলার আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করছে শত শত গরু-মহিষ। দুই উপজেলায় এই পাচার চক্র গড়ে গত এক বছরে অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন অনেকে। এই চক্র এতটাই শক্তিশালী যে, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও হামলা চালাতে পিছপা হয় না। এমনই এক ঘটনায় গত শুক্রবার ৪৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশীয় খামারের গরু দাবি করে মিয়ানমার থেকে আনা অবৈধ গরুর জাল সনদ তৈরি করে বৈধ দেখিয়ে গরু পাচার করা হচ্ছে। প্রতিটি গরু ও মহিষ মিয়ানমার থেকে ৬০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকায় কিনে তা বিক্রি করা হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়।

আসছে শতকোটি টাকার গরু-মহিষ
বিজিবি ৩ জানুয়ারি জানায়, আলীকদমে যৌথ অভিযানে বিগত ৬ মাসে ৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকার ৮০৭টি গরু ও মহিষ আটক করে আলীকদম ৫৭ বিজিবি। অবৈধ গরু আটকের বিষয়ে এ পর্যন্ত ২৬টি মামলা করা হয়েছে। দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।

এরপর আলীকদমের দুর্গম নয়াপাড়া ইউনিয়নের শিরঝিরি এলাকায় ৫ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে মিয়ানমার থেকে আনা ১৬০টি গরু আটক করে বিজিবি। এর আগে গত ২৪ ও ২৫ অক্টোবর বান্দরবানের আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ২৩টি গরু-মহিষ আটক করে পুলিশ। ২৬ অক্টোবর লামার মাতামুহুরী নদীর শীলেরতুয়া ও রাজবাড়ী এলাকা থেকে ১২টি গরু-মহিষ আটক করা হয়। এরপর গত ৩ ডিসেম্বর আলীকদমের কুরুকপাতার আওয়াইপাড়া থেকে আটক করা হয় ৩০টি গরু। ২২ ডিসেম্বর লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের মিরিঞ্জা থেকে ৯টি গরু আটক করে পুলিশ। একই ইউনিয়নের ইয়াংছা শামুক ছড়ায় ৩১টি গরু-মহিষ আটক করা হয়। বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন গত ২৯ ডিসেম্বর নাইক্ষ্যংছড়িতে ফের ৩০টি গরুসহ পাঁচ চোরাকারবারিকে আটক এবং পাঁচটি ডাম্পার গাড়ি জব্দ করে। পরদিনই আলীকদমের চৈক্ষ্যং ইউনিয়ন থেকে পুলিশ ৪৪টি গরু ও তিনটি ট্রাক জব্দ করে এবং তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।

এদিকে নাইক্ষ্যংছড়িতে কয়েক দিন আগে পুলিশের ওপর গরু পাচারকারীরা হামলা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই ঘটনায় ২-৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গত শুক্রবার ৪৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে থানা পুলিশ। স্থানীয়দের ধারণা, আটকের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ বেশি গরু-মহিষ পাচার হচ্ছে বান্দরবানে।

যেসব রুট ব্যবহার করছে পাচারকারীরা
মিয়ানমারের সঙ্গে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ১১ বিজিবির ব্যাটালিয়ন সীমান্ত ৭১ কিলোমিটার ও জোনের অধীনে ৯৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এই জোনের অধীনে নিকুছড়ি থেকে তীরেরডিব্বা পর্যন্ত বর্ডার অবজারবেশন পোস্ট (বিওপি) রয়েছে ১৪টি। আর কক্সবাজারের ঘুমধুম থেকে মনজয়পাড়া পর্যন্ত বিওপি রয়েছে আটটি। এরপর সীমান্ত পিলার ৫৫ থেকে আলীকদম ৬৮ নম্বর পোয়ামুহুরী পর্যন্ত এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন (অরক্ষিত) রয়েছে। ফলে নাইক্ষ্যংছড়ির আশারতলী, ফুলতলী, লেমুছড়ি, চাকঢালা, ঘুমধুম সীমান্ত; অন্যদিকে আলীকদমের করুক পাতা ও পোয়ামুহুরির বিভিন্ন ঝিরি দিয়ে অবাধে মিয়ানমার থেকে আসছে গরু-মহিষ, যা জেলার লামার ইয়াংছা শামুক ছড়া, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের মিরিঞ্জা ও কক্সবাজারের রামু, চকরিয়া দিয়ে পাচার করা হয়। অন্যদিকে নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী সদর থেকে ৩২ কিলোমিটার উত্তরে পাহাড় দিয়ে কক্সবাজারের ঈদগড়-ডুলাহাজারা হয়ে প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০টি ট্রাকে করে কক্সবাজারের চকরিয়ায় গরু পাচার হয়। অল্প টাকার বিনিময়ে পাচারকারীরা এসব কাজে ব্যবহার করেছে ম্রো তরুণ-তরুণী ও রোহিঙ্গাদের।

আলীকদমের কুরুকপাতা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় দুর্গম সীমান্ত বড় আঘলা থেকে গত সোমবার সন্ধ্যায় আতিকুর রহমান (৩৫) ও জসিম উদ্দিন (৫৫) নামের দুই ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, এই দুই ব্যক্তি গরু পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। তারা সম্পর্কে শালা-দুলাভাই।

কুরুকপাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো বলেন, মিয়ানমারের গরু চোরাকারবারিরা ওই দুজনের কাছে এক কোটি টাকা পাওনা থাকায় তাদের ধরে নিয়ে গেছে বলে জেনেছি।

NewsDetails_03

পাচারে জাল কাগজপত্র
বান্দরবানের আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত দিয়ে গরু পাচারে নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্ট ফাঁকি দিতে পাচারকারীরা তৈরি করছে জাল কাগজপত্র। গত ২০ সেপ্টেম্বর ৪১টি গরু তিনটি ট্রাকে করে পাচারের সময় কানামাঝি আর্মি চেকপোস্টে পৌঁছলে খবর পেয়ে বিজিবি ও ইউএনওসহ গঠিত ট্রাস্কফোর্স গরুগুলো আটক করে। এরপর জানা যায়, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে গরুগুলো এনে বৈধ করার চেষ্টা করেছিলেন আলীকদম উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুচ মিয়া। এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেছেন উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ ইবনে রাওহা পারভেজ।

যাদের বিরুদ্ধে পাচারের অভিযোগ
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য, অনুসন্ধান ও স্থানীয় সূত্র জানায়, জেলার আলীকদম উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক ইউনুচ মিয়া, আবছার, মনু, মংচিং মার্মা, আবু সালাম,আব্দুল হামিদ, মনুচিং মারমা, মইউ মারমা, জুলফিকার আলী ভুট্টো, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাবেদ হোসেন রুবেল, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোঃ সোহেল, এমএনডিপি’র সাবেক কমান্ডার মেন রুম ম্রো, আলীকদম সদর ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দার মোঃ ইউনুচ মিয়া, মোঃ নজরুল ইসলাম, মোঃ রুহুল আমিন, মোঃ ইলিয়াস মিয়া, মোঃ ফরিদ উদ্দিন, মোঃ সাদ্দাম হোসেন, মোঃ লালু (প্রকাশ বার্মায়া লালু), প্রদীপ দে, মোঃ হারুনুর রশীদ, মোঃ সালাউদ্দিন, চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের বাসিন্দার মোঃ জামাল উদ্দিন, মোঃ সজিব কামাল, মোঃ লিটন, নয়াপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, মোঃ সরোয়ার আলম, মোঃ জামাল উদ্দিন, কুরুকপাতা ইউনিয়নের কামলাই ম্রো, স্থানীয় একজন সাংবাদিক, লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি নুর হোসেন চৌধুরী ও ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার, আওয়ামী লীগ নেতা কুতুব উদ্দিন, আপ্রু ছিং মেম্বার, মংবাগ্য মেম্বার, আ.লীগ নেতা লুতফর রহমান, কুতুবউদ্দিন মেম্বার, পৌর কাউন্সিলর উসুইথোয়াই, স্থানীয় মেয়রের ভাই সোহেল, নাছির মেম্বার’ সহ অসংখ্য ব্যাক্তি জড়িত।

পাচার রোধে স্থানীয় প্রশাসন
গত ৩ জানুয়ারি নাইক্ষ্যংছড়ি অফিসার্স ক্লাবের হলরুমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোমেন শর্মার সভাপতিত্বে গরু চোরাচালান রোধে উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে আসা গরু, মহিষ চোরাচালান রোধে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি উপজেলার ৫ ইউনিয়নের খামারিদের লিপিবদ্ধ করার প্রস্তাব আনা হয়। অন্যদিকে আলীকদম ৫৭ বিজিবি জানায়, চোরাচালান রুখতে আলীকদমের পাইনছড়া-পিলায়পাড়া পয়েন্টে বিজিবি ও আনসারের যৌথ অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হবে।

যা বলছে প্রশাসন ও স্থানীয়রা
লামা উপজেলার খামারি আবদু সত্তার ও এসহসান উল্লাহ বলেন, মিয়ানমার থেকে গরু আনার কারণে দেশীয় গরুর চাহিদা ও দাম কমে গেছে। তাই এক থেকে দেড় বছর গরু লালন-পালনের পর বিক্রি করলে লাভের মুখ দেখতে পারছেন না খামারিরা।

আলীকদম ৫৭ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, গরুসহ চোরাচালান শুধু এলাকার ভারসাম্য নয়, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে। ফলে সরকার একদিকে যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চোরাচালান রুখতে বিজিবি সক্রিয়।

নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নূরুল আবছার ইমন বলেন, গরু পাচার রুখতে স্থানীয় খামারিদের ও খামারে কয়টি গরু আছে সেই তালিকা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। এর বাইরে গরু এলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আলম কোম্পানি বলেন, বাইশারী দিয়ে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০টি গরু পাচার হয়। পাচার রোধ করতে গত মঙ্গলবার উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির বিশেষ সভা হয়। আশা করছি, এর সুফল পাওয়া যাবে।

এ ব্যাপারে আলীকদম উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফুল্লা নিজামী বলেন, অবৈধ গরু ও মহিষ পাচারের বিরুদ্ধে বিজিবিসহ আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে, অনেককে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন