বান্দরবান সীমান্তের গডফাদার শাহীন এর অপরাধ সাম্রাজ্য

হত্যা, অস্ত্র, ডাকাতিসহ ১৭টি মামলা

একসময় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজার এলাকার ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন শাহীনুর রহমান ওরফে ডাকাত শাহীন। অপহরণ, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, বাগান দখল এবং রাতে মানুষের বাড়ি থেকে গৃহপালিত গরু-ছাগল নিয়ে যেত শাহীন ডাকাতের সদস্যরা। এখন তিনিই পরিচালনা করেন, বাংলাদেশ- মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংছড়ি ও রামু সীমান্তের চোরাচালান।

রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ, কখনো গবাদি পশু, কখনো মাদক, কখনো স্বর্ণ, কখনো বা অস্ত্র চোরাচালান আটকের ঘটনায় প্রায় শিরোনামে আসে এই অঞ্চলটির নাম। এসব চোরাচালানের একছত্র অধিপতি বা গডফাদার মো.শাহীন উর রহমান ওরপে ডাকাত শাহীন বলে দাবি স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা জানান, একসময় শাহীন ডাকাত এলাকায় অপহরণ, চাঁদাবাজি, বাগান দখল এবং রাতে মানুষের বাড়ি থেকে গৃহপালিত গরু-ছাগল ডাকাতি করতেন। ফাঁকা গুলি ছুড়ে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করতেন। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছিল কয়েক বার, জামিনে মুক্ত হয়ে ফের বাড়াতে থাকে তার জন্য তার অপরাধ কর্মকান্ড পরিসীমা।

এখন বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের কক্সবাজারের রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা জুঁড়ে নিয়ন্ত্রন করছে সকল চোরাচালান।

এসব চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে তার রয়েছে প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীও। শাহীনের অপরাধ সম্রাজ্যে যুক্ত রয়েছে অন্তত ১ হাজার জনেরও বেশী স্থানীয় বাসিন্দা। যাদেরকে চোরাচালান পটার বা বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২-৩ হাজার টাকার বিনিময়ে বাহকরা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চোরাই পন্য আনতে গিয়ে স্থল মাইন বিষ্ফোরণের কবলে পড়ে পঙ্গুত্ববরণ ও নিহত হয়েছে অনেকেই।

বিভিন্ন সময় চোরাচালান বিরোধী অভিযানে চোরাচালানসহ বাহককে আটক করা গেলেও অধরা থেকে যায় চোরাচালান চক্রের মূলহোতারা। তবে আটকদের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে শাহীন উর রহমান ওরপে ডাকাত শাহীন, জামসেদ ও শাবুদ্দিন কালুর নাম।

এদের সাথে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সাথে সখ্যতা থাকায় মিয়ানমার থেকে অবৈধ পন্থায় নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি এবং রামুর হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটা পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে অস্ত্র, ভয়ংকর মাদক (ইয়াবা ট্যবলেট,আইসসহ বিভিন্ন মাদক),স্বর্ণ, গরুর-মহিষ, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মিয়ানমারের নাগরিকদেরও। সম্প্রতি গরু-মহিষ চোরাচালানে যুক্ত করা হচ্ছে এলাকার শিশু-কিশোরদেরও।

গরু চোরাচালানের বিষয়ে জানা যায়, অবৈধ পন্থায় মিয়ানমার থেকে প্রতিটি গরু ও মহিষ ৬০-৭০ হাজার টাকায় কিনে এক থেকে দেড় লাখ টাকায় তা বিক্রি করা হয়। এসব গরু-মহিষ দেশীয় খামারের দাবি করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যায়ন ও গর্জনিয়া বাজারসহ বিভিন্ন হাট বাজারের হাসিল (কর) আদায় রশিদ দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

NewsDetails_03

এচোরাচালান প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয় মূলত ডাকাত শাহীন, জামসেদ ও শাবুদ্দিন কালুর মাধ্যমে। এদের বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলে তাকে জীবন বাঁচাতে এলাকা ছাড়তে হয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে চোরাচালান প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনা করায় সশস্ত্র হামলা চালায় চোরাকারবারিরা। এনিয়ে ২৫০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এমনকি কোন সরকারি কর্মকর্তা যদি তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে কোনঠাসা করা হয় তাকেও।

একাধিক সুত্র বলছে, ডাকাত শাহীনের নিয়ন্ত্রণে অস্ত্র তৈরির কারিগর, অস্ত্র প্রশিক্ষক, ডাকাত শাহিন বাহিনী নামে ২০০ জনের অধিক সশস্ত্র লোকবল। যার মধ্যে চলতি বছরের গত ২৫ ফেব্রুয়ারী গ্রুপটির ভিকসান মিয়া নামে এক অস্ত্র পরিচালনা প্রশিক্ষককে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করে পুলিশ। চোরাচালান প্রক্রিয়াটি থেকে আয়ের অংশ অস্ত্র ক্রয় ও বাহিনীর সদস্যদের পরিচালনায় ব্যবহার করলেও সিংহ ভাগ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে বলেন স্থানীয়রা।

ডাকাত শাহীন বাহীনির বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয়রা বলেন, ২০১২ সালের দিকে অপরাধ জগতে জড়ায় শাহীন। ক্রমান্বয়ে ডাকাত দলের সরদার হয়ে রামু নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকা জুড়ে কায়েম করেন তার অপরাধ জগতের সাম্রাজ্য।

বাহিনীটির কাছে রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির ৬ ইউনিয়নের প্রায় অর্ধলাখের বেশি মানুষ জিম্মি রয়েছে। তার নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি সাবেক ইউপি সদস্যও। রাতের বেলা রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় দলবদ্ধ সশস্ত্র মহড়া দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার প্রতিবাদ করায় ইউপি সদস্য
মনিরুল আলমকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল তার দুই পা। এমনকি এই ডাকাত শাহীনকে গ্রেফতারের দাবিতে এলাকায় মানববন্ধনও করেছিল সাধারণ জনগন।

তথ্যমতে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং পুলিশের যৌথ অভিযানে রামু গর্জনিয়া শিবাতলী পাহাড়ি এলাকার গোপন আস্তানা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন শীর্ষ ডাকাত শাহীন উর রহমান ওরফে ডাকাত শাহীন। সে সময় প্রায় তিন বছর কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও জড়িয়ে পড়েন অপরাধে। পরে ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি ৫টি ডাকাতি, ৩টি অস্ত্র, ১টি মাদক, ৪টি হত্যা চেষ্টার মামলায় ডাকাত শাহীনের সহযোগী তারেক জিয়াকে আটক করেছিল র‍্যাব-১৫। সেবারও জামিনে মুক্ত হয়ে চালাচ্ছেন অপরাধ কর্মকান্ড।

এবিষয়ে জানতে শাহীন উর রহমান, জামসেদ ও শাবুদ্দিন কালুর সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।

পুলিশ জানায়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের রামু থানায় হত্যা, অস্ত্র চোরাচালান, ডাকাতি ও গরু পাচারসহ ১৭ টি মামলা রয়েছে শাহীন উর রহমান ওরফে ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে। জামসেদের বিরুদ্ধে রয়েছে ১২টি। বিভিন্ন অভিযোগে শাহাবুদ্দিন কালুর বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা।

নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসরুরুল হক বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এলাকাটিতে কিছুটা অপরাধ প্রবনতা রয়েছে, তবে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে ।

আরও পড়ুন