সবুজ পাহাড়ে ধূসর রঙের ছনের চালার ঘর এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। রোদে চিকচিক করা রূপালি ঢেউটিনের চালা বহুদূর থেকেই জানান দেয় তার সদম্ভ অস্তিত্বের কথা। সবুজের ফাঁকে তাই সাদার ঝিকিমিকি। আর হাজার বছরের পরম বন্ধু অভিমানি ‘ছন’ তাই সন্তর্পনে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে চলেছে।
সময়ের শ্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে কম দামি ঢেউটিনের ব্যাপক ব্যবহারের মুখে চাহিদা কমে যাওয়ায় পাহাড়ে আর আগের মতো ছন চাষ করছেন না চাষিরা। ফলে দ্রুত ছনের চালার স্থান দখলে নিয়েছে কমদামি টিনের চালা। এমন চিত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতেই দেখা গেছে।
তবে কি পাহাড়ে সচ্ছলতা বিরাজ করতে শুরু করেছে? না!। সচ্ছল-অসচ্ছলতার প্রশ্নের চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে টিনের টেকসইয়ের বিষয়টি। এমন মন্তব্যই করেছেন ছন বিক্রেতা ও ব্যবহারকারীরা।
দীর্ঘদিন ধরে ছনের চাষ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন উপজেলার উত্তর নাইল্যাছড়ির জাহাঙ্গীর আলম (৩৫)। কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান বাংলা বর্ষের আশ্বিন থেকে চৈত্রমাস পর্যন্ত ছন আহরণ করা হয়ে থাকে। চাষাবাদে তেমন পরিশ্রম নেই। শুধুমাত্র পাহাড়ের যে অংশে ছন চাষ করা হবে তা পরিস্কার করে দিলেই কিছুদিন পর প্রাকৃতিকভাবেই ছনের কুঁড়ি জন্ম নেয়।
দেড় দুই হাত দৈর্ঘ্য হলে আগাছা পরিষ্কার করে একবার ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। আর ৬-৭ ফুট লম্বা হলেই কাটার উপযুক্ত হয়। আহরণের পর পর্যাপ্ত রোদে ১৫ থেকে ২৫ দিন শুকিয়ে নিতে হয়। এরপরই তা ব্যবহার উপযোগী হয়। অন্যদিকে বাগানে বড় কোনো গাছ থাকলে তার ছায়া ও পাতা পড়ে ছনের বৃদ্ধিতে যেমনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তেমনি ছনে পচন ধরে নষ্ট হয়। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়।
বর্ষা মৌসুম অনেক দুরে থাকায় আশ্বিন মাসে ছন আহরণ করা হলেও বাজারে এর চাহিদা তেমন থাকে না। ফলে ভারপ্রতি (দুই বোঝা) মাত্র ৬০ টাকায় বিক্রি করতে হয় বিক্রেতাদের। তবে ধীরে ধীরে এর চাহিদা যেমনি বাড়তে থাকে তেমনি দামও বেড়ে যায়। বর্ষা মৌসুম আসার আগেই এসময় ছন ব্যবহারকারিরা তাদের পুরনো ঘরের চালা মেরামতে উদ্যোগ নেওয়ায় বাজারে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তাই মৌসুমের শেষটায় চৈত্র মাসে ভারপ্রতি বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১৬০ টাকায়।
বিপরীত চিত্রও আছে। মন্দাভাবের কথা জানিয়ে ছন বিক্রেতা নাইল্যাছড়ির আব্দুল জলিল জানান-নিজের বাগানে চাষাবাদ করলে দিনে একজন শ্রমিক ছয় বোঝা ছন কাটতে পারে। কিন্তু কাঁচা অবস্থায় তা দূর থেকে বহন করে আনা সম্ভব হয় না। আবার শুকোতেও সময় লাগে ১৫ থেকে ২৫ দিন। নিজের বাগান না থাকলে বিভিন্ন উন্মুক্ত পাহাড় থেকে খুঁজে খুঁজে ছন আহরণ করতে হয়।
উপার্জনে অনিশ্চয়তার শঙ্কা নিয়ে তিনি আরো বলেন-আগের মতো চাহিদা না থাকায় দামও পাওয়া যায় না ভালো। ফলে একাজে শ্রম না দিয়ে বরং অন্য কাজে দিলে দৈনিক ৩০০ টাকা আয় করা যায়। তাই এই পেশার উপর নির্ভর করা যায়না। ফলে পেশা পরিবর্তন করা ছাড়া উপায় থাকছে না।
কথা হয় ছন ক্রেতা পোয়াপাড়া এলাকার আব্দুল জলিলের (৩০)’র সাথে। তিন ভার ক্রয় করেছেন তিনি। জানালেন ছন মাত্র এক বছর ব্যবহার করা যায়। তবে এবারও অর্থের সঙ্কুলান না হওয়ায় ঘরের চালায় টিন লাগাতে পারেন নি। পোয়াপাড়ার চাষি খোরশেদ আলম জানান, ফি-বছর ছন ক্রয় ও চালা মেরামতে শ্রমিকের পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয় ঐ পরিমাণ অর্থ দুই বছর জমা করে ঘরে ঢেউটিন লাগানো যায়। তাই টিনের ব্যবহার দ্রুতই বাড়ছে।
পোয়াপাড়ার পান চাষি নির্মল কান্তি দাশ জানান, অনেক চাষিরা ছনের বিকল্প ব্যবহার শুরু করেছেন ইতিমধ্যে। বিশেষতঃ ধনিয়া পাতা চাষের জন্য ক্ষেতের চারপাশে বেড়া এবং উপরে রোদ প্রতিরোধক চালা তৈরি করছেন এই ছন ব্যবহার করে। তিনি নিজেও পানের বরজে ছন ব্যবহার করছেন।
কলমপতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যজাই মারমা জানান, পাহাড়ে ছনের উৎপাদন ও ব্যবহার কমে যাওয়ায় এটি এখন বিলুপ্তির পথে। মূলত ফি-বছর ছন ক্রয় ও চালা মেরামতের পিছনে অর্থ ব্যয় না করে সবাই কমদামি ঢেউটিন ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। আবার নেহায়েত অস্বচছল মানুষেরা সামর্থ না থাকায় ছনের উপরই ভরসা রাখছেন মাথা গুজার জন্য। তবে এক সময় হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত মাথা গুজার ঠাঁই এই ছন হারিয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। এর নানাবিধ ব্যবহার বাড়ানো গেলে হয়তো ছন রক্ষা করা সম্ভব হতো।