দীর্ঘ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি বান্দরবানের লামা-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী স্থানে প্রস্তাবিত সরকারি বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষার ‘অভয়ারণ্য প্রকল্প’টি। ফলে একদিকে যেমন পাহাড় থেকে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তেমনি বন উজাড় ও বন্যপ্রাণির খাদ্য সংকটের কারণে বন্যহাতি ক্ষিপ্ত হয়ে লোকালয়ে নেমে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতিসাধণ করছে। আবার মানুষের শিকারেও মারা পড়ছে এসব বন্যপ্রাণী। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকায় প্রকল্পটির কাজ শুরু করা যাচ্ছেনা বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। মানুষ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় দ্রুত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বন ও পরিবশে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
সূত্র জানায়,পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে বান্দরবান পার্বত্য জেলার মাতামুহুরী ও সাংগু রিজার্ভ ফরেস্ট রয়েছে। এ দুটি রিজার্ভ ফরেস্ট ছাড়াও সরকারি বনাঞ্চল থাকলেও বন কর্মচারীদের মদদে এবং একশ্রেণীর কাঠ চোরাকারবারীদের কারণে নির্বিচারে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বন উজাড় ও বন্যপ্রাণির খাদ্য সংকটের কারণে পাহাড় থেকে বিভিন্ন প্রাণি বিলুপ্ত হওয়ার পর্যায়ে। প্রতিনিয়ত বন্যহাতি ক্ষিপ্ত হয়ে লোকালয়ে নেমে জান ও মালের ব্যাপক ক্ষতিসাধণ করে চলেছে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিগত জোট সরকারের আমলে বান্দরবানে বন্যপ্রাণি রক্ষার জন্য একটি ‘অভয়ারন্য’ গড়ে তোলার দাবি জোরালো হয়। দাবির প্রেক্ষিতে তৎকালীন বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী একটি বন্যপ্রাণির অভয়ারন্য গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। এ প্রেক্ষিতে বান্দরবান জেলা প্রশাসন লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে জায়গা চিহ্নিত করতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নির্দেশ দেয়। সে অনুযায়ী তৎকালীন নির্বাহী অফিসাররা তাদের প্রতিবেদনও দাখিল করেন কিন্তু পরবর্তীতে এ কার্যক্রম আর এগুয়নি। এ কারণে পাহাড়ে বন্যপ্রাণি বিশেষ করে বন্যহাতি বন উজাড় হওয়ায় আবাসস্থল ও খাদ্য সংকটে পড়ে। ফলে বন্যহাতি লোকালয়ে নেমে এসে বসত বাড়ির ওপর হামলা চালাচ্ছে, জমির ফসল নষ্ট করছে, গাছপালা দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। সর্বোপরি শিশু ও বৃদ্ধসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকে পায়েও শূঁড় দিয়ে, পদ পিষ্ট করে হত্যা ও আহত করছে।
গত কয়েক বছরে লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাসহ গোটা বান্দরবানে প্রায় অর্ধশত মানুষ হাতির আক্রমণ মারা গেছে, আহত হয়েছে অসংখ্য। সারা বছর জুঁড়ে হাতি আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটায় উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ। ফলে রিজার্ভ ফরেস্ট বনদস্যুদের কবল থেকে রক্ষা, হাতির আক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা ও মানুষের আক্রমণ থেকে হাতি রক্ষায় বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য গড়ে তোলার দাবি আরো জোরালো হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় বান্দরবানের থানচি উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হ্লাফসু মারমা জনস্বার্থে বাদি হয়ে বান্দরবান যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর একটি মামলাও (অপর মামলা নং- ২৩১/২০১১) দায়ের করেন। বিজ্ঞ আদালত রিজার্ভ ফরেস্ট সংরক্ষণ, বন উজাড় বন্ধ, বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য গড়ে তোলার বিষয়ে বিভিন্ন যুক্তি ও দাবি উপস্থাপন করে কতিপয় আদেশ দেন। আদেশে বন ও পরিবেশ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বান্দরবানের তিন বিভাগীয় বন কর্মকর্তাসহ ৮ জনকে নোটিশ প্রাপ্তির ২০ দিনের মধ্যে বন বিভাগ, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় কার্যকর ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না এ কারণ দর্শানোর জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞাও (ম্যান্ডেটরী টেম্পটারী ইনজাংশন) জারি করেছিলেন। পরে সরকার অভয়ারণ্য ঘোষনা করে গেজেটও প্রকাশ করে। কিন্তু প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকার কারণে এখনো বাস্তবায়ন হয়নি প্রস্তাবিত প্রকল্পটি।
মামলার কাগজপত্র সূত্রে জানা যায়, মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত বান্দরবানের মাতামুহুরী ও সাংগু রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকার বন হতে বন্য প্রাণি লোকালয়ে বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়ি, বাগান ও চাষাবাদের জমিতে যেন আসতে না পারে বা বন্য প্রাণি লোকালয়ে আসলে দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং নিরাপদ দূরত্বে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণসহ মানুষ যেন সংরক্ষিত বনে বা বন্যপ্রাণির আবাসস্থলে গিয়ে তাদের খাবার ও আবাস নষ্ট করতে না পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নিতে হবে। আদেশে আরও বলা হয়, জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষা বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রধান ইস্যু। এই ইস্যুতে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে। মানুষ, প্রাণি ও বৃক্ষ- এই তিন প্রাণের সম্মিলনে আমাদের পরিবেশ, আমাদের পৃথিবী। এদের খাবার ও চারণভুমি দরকার। এই লক্ষ্যে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ করতে অভয়ারণ্য গড়ে তোলার জরুরি হয়ে পড়ায় জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করে বিজ্ঞ আদালত।
লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ফকিরাখোলা এলাকার হাতি আক্রান্ত নুরুল আলম বলেন, হাতিগুলো প্রথমে বাড়ীর চারিদিকে ঘেরাও করে ফেলে। বিশেষ করে ঘরের দরজা জানালার পাশে পাহারাদারের মত দাঁড়িয়ে থাকে। আর ঘর ভাঙ্গা শুরু করে। পরে ঘরে থাকা ধান চাল খেয়ে চলে যায়। রাতজেগে বাড়ি ঘর পাহারা দিয়ে হাতির আক্রমন থেকে রক্ষার চেষ্ঠা চালাচ্ছে স্থানীয়রা। তিনি আরও বলেন, গত এক মাসে হাতির পাল তান্ডবে ৫০-৫৫টি বসতঘর তছনছ করে দিয়েছে, হামলায় এক নারীসহ আহত হযেছেন ১০জন।
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসাইন মামুন বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রাত জেগে আগুন জ্বালিয়ে ও ঢোল পিটিয়ে চিৎকার করেও বন্য হাতির দলকে সরানো যায় না। বেশি ভয় দেখালে হাতির পাল গায়ের দিকে তেড়ে আসে। তাই অভয়ারণ্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে।
এদিকে বাদি পক্ষের মামলা পরিচালনাকারী বান্দরবান জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ডক্টর মহিউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, জনস্বার্থে দায়েরকৃত এই মামলায় বিজ্ঞ আদালত প্রথম দিনে যে আদেশ দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন হলে রিজার্ভ ফরেস্ট রক্ষার পাশাপাশি বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য গড়ে তোলার কাজ সহজ হত। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। এতে করে অভয়ারণ্য প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরুত্ব বুঝার মত আর কেউ রইল না বলে জানান তিনি।
লামা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রতিবছর বিশেষ করে লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও জেলা সদরের টঙ্গাবতি ইউনিয়নে বন্যহাতির আক্রমণে জান ও মালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাই প্রস্তাবিত স্থানে বন্যপ্রাণীর ‘অভয়ারন্য প্রকল্প’ বাস্তবায়ন হলে জান-মালসহ বন্যপ্রাণীও রক্ষা পাবে।
এ বিষয়ে লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন আহমদ জানান, লামা-নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী স্থানকে ইতিমধ্যে অভয়ারণ্য ঘোষনা করে গেজেটও প্রকাশ করেছে সরকার। তবে বরাদ্দ না থাকায় প্রকল্পের যাবতীয় কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। বরাদ্দ সাপেক্ষে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক বলেন, বন্যপ্রাণী ও মানুষের প্রাণ রক্ষায় লামা-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে প্রস্তাবিত অভয়ারণ্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন অতীব জরুরী।