লামায় কৃষি জমির মাটি কেটে সাফ : পরিবেশ ও ফলন উৎপাদনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

NewsDetails_01

লামায় কৃষি জমির উপরিভাগ কেটে নেওয়া হচ্ছে
বান্দরবানের লামায় অবাধে কৃষি জমির উপরি ভাগের উর্বর মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে। ইটভাটা, রেল লাইন স্থাপন ছাড়াও বসতভিটা, পুকুর ও ডোবা ভরাট কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব মাটি। ভূমি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি বহিরাগত সিন্ডিকেট উপজেলার ফসলি জমির উপরিভাগ কেটে উজাড় করছে প্রতিনিয়ত, ফলে পরিবেশ ও ফলন উৎপাদনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।
আরো জানা গেছে, গত এক মাসে উপজেলার ফকিরাখোলা এলাকার প্রায় দেড়শ একর জমির উপরিভাগ কেটে নেয়া হয়েছে। ফলে এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন ও পরিবেশ বৈচিত্র্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এসব মাটি ভর্তি ভারি ট্রাক, ড্রাম, ট্রাক ও ট্রলি চলাচল করায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। টপ সয়েলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় কিছু অসাধু মাটি ব্যবসায়ী জমির মালিককে বিভিন্ন কৌশলে প্রলুব্ধ করে সামান্য অর্থের বিনিময়ে তা উজাড় করছে।
সরেজমিন জানা যায়, পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় সমতলের তুলনায় লামা উপজেলায় কৃষি জমির পরিমান অনেক কম। এরপরও উপজেলার ফাঁসিয়াখালীর ফকিরাখোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় এক্সকাভেটর দিয়ে গত এক মাস ধরে কৃষি জমির উপরিভাগের উর্বরা অংশ কেটে ট্রাক-ট্রলি করে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাটি কাটার গভীরতার পরিমাণ ৪ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে কোথাও কোথাও অর্থনৈতিক ও অনৈতিক আগ্রাসনে পার্শ্ববর্তী মালিকের জমিও নষ্ট হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্থানীয় বেশ কয়েকজন বলেন, ফকিরাখোলা গ্রামের আব্দু শুক্কর, আব্দুল্লাহ প্রকাশ কালা সোনা, রেজাউল করিম মানিক, সাকের উল্লাহসহ বেশ কয়েকজন ফসলের জমির মাটি বিক্রি করেছে। পাশের চকরিয়া উপজেলার ডুলহাজারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের নিয়ন্ত্রনে বার্মাইয়া দীল মোহাম্মদসহ বড় একটি সিন্ডিকেট মাটি নিয়ে যাচ্ছে। গত এক মাসে প্রায় দেড়শ একর জমির উপরিভাগ কেটে নেয়া হয়েছে বলেও জানান স্থানীয়রা। আর এসব মাটি যাচ্ছে চকরিয়া উপজেলার রেল লাইন স্থাপন, ইটভাটা আবার কেউ কেউ বসতভিটা, ডোবা ও পুকুর ভরাট কাজে।
সাকের উল্লাহ বলেন, আমি জমির মাটি বিক্রি করিনি। রেজাউল করিম মানিকসহ অন্যরনা মাটি বিক্রি করেছেন। একই অবস্থা বিরাজ করছে উপজেলার সরই, আজিজনগর ও ফাইতং ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে।
এলাকাবাসী জানায়, কোথাও কৃষককে বোঝানো হয়, তোমার জমি উঁচু, সেচের পানি নেমে যাবে, বোরো আবাদ হবে না। তাই উপর থেকে মাটি ভাটায় বিক্রি করে দাও। কোথাও বলা হয়, উপরের মাটিতে ভাইরাস-ময়লা। উপরের মাটি বিক্রি করে নিচের ‘ভালো’ মাটিতে চাষ করলে ভালো ফসল হবে। এভাবেই নানাভাবে কৃষককে বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত করা হয় ‘টপ সয়েল’ বিক্রির জন্য।
কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় যে কোনো ফলনযোগ্য জমির উৎপাদন শক্তি জমা থাকে মাটির ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি গভীরতায়। মাটির এই অংশেই যে কোনো ফসল বেড়ে ওঠার গুণাগুণ সুরক্ষিত থাকে। বীজ রোপণের পর এই অংশ থেকেই ফসলটি প্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণ করে। এই অংশটি একবার কেটে নিলে সে জমির আর মৃত্তিকা প্রাণ থাকে না। এমনকি ওই জমিতে ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে কোনো ফসল বেড়ে উঠবে না। এতে জমিটি পরিত্যক্তই হয়ে যায়।
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাকের হোসেন বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মাটি কাটার কারণে ইতিমধ্যে প্রায় কয়েকশত একর জমি আবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আমি মাটি কাটার সাথে জড়িত দীল মোহাম্মদ, আব্দু শুক্কুর সহ কয়েকজনকে ডেকে মাটি কাটতে নিষেধ করেছি। দুই একদিন বন্ধ রেখে আবার কাটা শুরু করেছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক জমির মাটি কাটতে নিষেধ করেন। তারপরেও কিছুতেই থামছে না মাটি ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা। অন্যদিকে চলাচলে নিষেধ থাকলেও মাটি ভর্তি ভারি ট্রাক, ড্রাম, ট্রাক ও ট্রলি চলাচল করায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বিধায় ওই এলাকার রাস্তা দিয়ে এখন আর চলাচল করা যায়না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইটভাটার তত্ত্ববধায়ক জানান, মাটি ব্যবসায়ীরা তাদের ইটভাটার মাটি সরবরাহ করে থাকে। ভাটা মালিকরা কেউ টপ সয়েল কাটায় জড়িত নয়। তবে মাটি কাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানায়, দিনমজুর হিসেবে কাজ করে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি পায়। মাটি ব্যবসায়ীরা আমাদের কাজে নিয়ে আসছেন। এলাকার জমির মালিকরা জানান, তার জমিটি আশপাশের জমি থেকে কিছুটা উঁচু। উঁচু জমিতে সেচের পানি দিতে কষ্ট হয়। আবার উঁচু জমিতে পানি বেশিক্ষণ ধরেও রাখা যায় না। এ জন্য তিনি উপর থেকে মাটি বিক্রি করে ‘জমি সমান’ করছেন।
এ বিষয়ে ডুলহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, জমির মালিক সাকের উল্লাহ, রেজাউল করিম মানিক ও আব্দু শুক্কুর স্থানীয় দীল মোহাম্মদের কাছে জমির উপরিভাগ বিক্রি করেছেন। আমি দীল মোহাম্মদদের কাছ থেকে ওই মাটি কিনেছি।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সানজিদা বিনতে সালাম জানান, মাটির জৈব ও পুষ্টি উপাদান উপরিভাগের ৩ থেকে ৫ ইঞ্চির মধ্যে বিরাজমান। ফলে এই মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া যে কী ভয়াবহ ক্ষতি তা কৃষকরা জানেন না। অথচ এই ‘টপ সয়েল’ পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ১৫ থেকে ২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগে। তাই কৃষি জমি রক্ষায় কৃষকদের এই মারাত্মক প্রবণতা থেকে সরিয়ে আনা দরকার।
জানতে চাইলে লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে জমির উপরি ভাগের অংশ কেটে মাটি পাচারের ঘটনায় মৌখিকভাবে নিষেধ করার পাশাপাশি জেলা প্রশাসক ও সেনাবাহিনীকে অবগত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন