সবচেয়ে খারাপ সময়ে পর্যটন শিল্প

imagesস্প্যানিশ পর্যটক আনার মন খুবই খারাপ। বাংলাদেশে এসেছেন তিন-চার দিন হয়ে গেল। ‘বান্দরবান’ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। পাহাড়িকন্যা বান্দরবানের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক পরিবেশ, বিশেষ করে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। অথচ সেখানেই যেতে পারছেন না তিনি। পরিচিত সবাই তাঁকে এ সময়ে বান্দরবানে যেতে নিরুৎসাহিত করছেন। আনা এ নিয়ে কমপক্ষে পাঁচবার এসেছেন বাংলাদেশে। বলা যায়, বাংলাদেশের প্রেমেই পড়ে গেছেন তিনি। প্রতিবছর বার্ষিক ছুটি পেলেই ছুটে আসেন বাংলাদেশে। গন্তব্য বান্দরবান। কিন্তু এবার বনানীর একটা ছোট হোটেলে উঠলেও ভয়ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে ঢাকায় নীরবে-নিভৃতে কয়েকটা দিন কাটিয়েই মন খারাপ করে ফিরে গেলেন নিজ দেশ স্পেনে।

শুধু আনাই নন। জাপানি পর্যটক তোশিও কিংবা আমেরিকান পর্যটক গ্যারিরও ভীষণ মন খারাপ। প্রায় প্রতিবছরই তাঁদের বাংলাদেশে আসা হয়। এর আগে ঘুরে বেড়িয়েছেন নির্বিঘ্নে-নিশ্চিন্তে, একা-একা। কিন্তু বর্তমানে কী এক ভয়, শঙ্কা আর অস্বস্তিতে কোথাও বের হতে পারছেন না। সাহস নিয়ে বের হতে চাইলেও পরিচিত বন্ধুবান্ধব আর পরিবার-পরিজন তাঁদের মোটেও উৎসাহ দিচ্ছেন না। তার ওপর আবার রয়েছে নিজ নিজ দেশের ট্রাভেল অ্যালার্ট, যেখানে স্পষ্টভাবে বাংলাদেশ হয় রয়েছে রেড জোনে, নয়তো বাইরে না বের হওয়ার সতর্ক নির্দেশ। তাই অগত্যা হোটেলেই রাতযাপন শেষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন।

আজ ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস আর এই হলো বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের বর্তমান হালচাল। গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির নৃশংস বিদেশি হত্যাকাণ্ড এবং পরে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার জঙ্গি হামলার ঘটনায় প্রায় শেষ হয়ে গেছে বিদেশি পর্যটকদের বাংলাদেশে আগমন। দেশের প্রথম সারির প্রায় সব ইন-বাউন্ড ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেকেরই ২০১৬ সালের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ট্যুরই ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে।

এমনকি ২০১৭ সালের প্রথমার্ধের অনেক ট্যুরও হয় বাতিল কিংবা অপেক্ষমাণ রয়েছে। বিদেশি অপারেটর এবং পর্যটকেরা বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। আর এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এসেছে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর। যদি নিরাপত্তার অজুহাতে ইংল্যান্ড বাংলাদেশে না আসত, তবে তা হতো আমাদের জন্য অনেক বেশি উদ্বেগের—দেশের পর্যটনশিল্পের জন্য তো বটেই।

NewsDetails_03

২০১৬ সালকে বর্তমান সরকার ‘পর্যটন বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। পর্যটন মন্ত্রণালয় এই সময়ে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে নিয়ে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। পর্যটন মন্ত্রণালয়, ট্যুরিজম বোর্ড এবং বেসরকারি পর্যটন উদ্যোক্তারা যখন আন্তর্জাতিক বিপণন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের দেশে নিয়ে আসতে কাজ করছিলেন, ঠিক সেই সময়েই গুলশান আর শোলাকিয়ার ঘটনা পুরো প্রক্রিয়াকেই শেষ করে দেয়। যদিও এই জঙ্গিবাদ এখন আর বাংলাদেশের একার কোনো ইস্যু নয়; বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কিন্তু পৃথিবীতে উন্নত দেশগুলো এই জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে পরিমাণ দক্ষ, আমরা এখনো তেমন হয়ে উঠতে পারিনি কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, আমাদের সক্ষমতা এখনো সে পর্যায়ে উন্নীত হয়নি।

উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, ফ্রান্সে সম্প্রতি প্যারিস ঘটনা ঘটার দিন দশেকের মধ্যেই তারা জলবায়ু-সংক্রান্ত একটি উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের আয়োজন করে, যেখানে পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রপ্রধানই অংশগ্রহণ করেন। আমাদের দেশেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট কাজ করছে, কিন্তু তারপরও আমাদের বিদেশি কাউন্টার-পার্ট আর পর্যটকেরা আস্থার সংকটে ভুগছেন। এ ক্ষেত্রে দেশের গণমাধ্যমগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়নি বলেই মনে হয়। আর সরকারও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যভাবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারেনি।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পর্যটন দিবস’। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার আহ্বানে ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার একটি সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। এ উপলক্ষে রেডিও-টিভিতে বিশেষ আলোচনা, টক শো, পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র, সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম কোনো কিছুরই কমতি হবে না। সবাই পর্যটনশিল্পের জয়গান গাইবে। বাংলাদেশ হচ্ছে পর্যটনে সমৃদ্ধ একটি দেশ। সরকার দেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বিবিধ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু বিনীতভাবে জানতে চাই, এতে করে কি বিদেশি পর্যটকদের মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক আস্থা ফিরে আসবে? জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে? কিংবা ভবিষ্যতে এ-জাতীয় ঘটনা আর না ঘটার নিশ্চয়তা কি বিদেশি পর্যটকদের আমরা দিতে পারব—যেটি তাঁদের প্রধানতম জিজ্ঞাসা?

স্বাধীনতার পরে দেশের পর্যটনশিল্পের ওপর এত বড় আঘাত আর আসেনি। আর এখনই উপযুক্ত সময় সবাই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। আসুন, সবাই একতাবদ্ধ হয়ে সরকারের পাশাপাশি ওই সব জঙ্গিবাদ আর অপশক্তিকে রুখে দিয়ে সম্প্রীতি আর বন্ধুত্বের মেলবন্ধন তৈরি করি। আউল-বাউল, লালন, জীবনানন্দ, হাসন রাজা, রবীন্দ্র-নজরুলের এই দেশে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশের মানুষ পর্যটনবান্ধব। সদা হাস্যোজ্জ্বল এ দেশের সাধারণ মানুষ। আমাদের অকৃত্রিম আতিথেয়তায় ভেসে যাক সব জঙ্গিবাদ আর অপশক্তি—বিশ্ব পর্যটন দিবসে এই হোক আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা। সূত্র : প্রথমআলো

আরও পড়ুন