সৌর বাতির আলোয় কাটল পাহাড়ের আঁধার

NewsDetails_01

লামা পৌরসভাস্থ মাতামুহুরী ব্রিজের ওপর স্থাপিত সোলার স্ট্রিট
পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামািিট ও খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙ্গালী মিলে প্রায় ১৭ লাখ মানুষের বসবাস। এক সময় এতদ্বঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত মানুষগুলো রাতে ব্যবহার করত কেরোসিনের কুপি বাতি আর হারিকেন। বর্তমানে কেরোসিনের বাতি আর হারিকেনের পরিবর্তে ঘরে ঘরে এখন জ্বলছে সৌরবাতি। দিনের সূর্যের আলো সংগ্রহ করে রাতের অন্ধকার দূর করছে এ সৌর বিদ্যুৎ। এতে বদলে গেছে পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রা। এখন অনেকটা আধুনিকতার ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হয়েছে পাহাড়। আবার এ সৌর বিদ্যুতে চলছে কম্পিউটার ইন্টারনেট সার্ভিস, তথ্য সেবা কেন্দ্র, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন।
জানা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী’র সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকলেও তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানো অনেকটা দুরূহ ব্যাপার। তাই যেসব দুর্গম এলাকায় সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেখানে সৌর বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে মেগা প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে কিছু কিছু এলাকায় সৌর বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছাতে ২০১৫ সাল থেকে তিন জেলার ২৬টি উপজেলায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রম শুরু করা হয়। দুর্গম এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জনপদে ‘সোলার বিদ্যুৎ সরবরাহ’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ত্রাণ পুনর্বাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের উদ্যোগে স্থাপিত সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৫ বছরের মধ্যে তিন জেলার ১ লাখের বেশি মানুষ বিদ্যুৎ পাবে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, ত্রাণ পুনর্বাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের টিআর কাবিখা প্রকল্পের আওতায় ২০১৫ সাল থেকে চলতি অর্থ বছর পর্যন্ত আনুমানিক ২৫ হাজার ও ২০১৬ সাল থেকে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৫শ কোটি টাকা ব্যয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সৌর বিদ্যুতে জ্বলছে এখন বান্দরবানসহ তিন জেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সোলার স্থাপন ও মেঠোপথে স্ট্রিট লাইট বসানোর কাজ শুরু করা হয়। দেশের প্রত্যেক জেলা বা উপজেলা শহরের মতো বিদ্যুৎ প্লাান্টে যান্ত্রিক সমস্য, লোডশেডিং ও লো-ভোলটেজ বিড়ম্বনা নেই দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। দিন রাত ২৪ ঘণ্টায় বিদ্যুত পাচ্ছে সৌর প্লান্টের মাধ্যমে। কোন আবেদন, জামানত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াই বিনামূল্যে পাচ্ছেন সোলার প্যানেল।
সূত্র আরও জানায়, একবার সৌর বিদ্যুত বসালে ২০ বছর এর সুবিধা ভোগ করা যায়, যে কারণে এর চাহিদা বেড়েই চলেছে। ৮৫-১০০ ওয়াটের একটি সৌর প্যানেলে একটি সাদা কালো টিভি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ৭-৮ টি লাইট ও একটি ফ্যান চলে। ২০ বছর আলো সরবরাহ করে থাকে এ সিস্টেম। ছোট, বড় ও মাঝারি ধরনের সোলার প্যানেল রয়েছে। এছাড়া সোলার বিদ্যুত ব্যবসা বাণিজ্যেরও পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ত্রাণ ও পুণর্বাসন মন্ত্রণালয়ের আওতায় উপজেলায় ১ হাজার ৪২৫টি সোলার প্যানেল বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এ হিসেবে বান্দরবানে প্রায় ৭ হাজার, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় আরও প্রায় ১৫ হাজার সোলার প্যানেল বিতরণ করা হয়।
লামা পৌরসভা এলাকার চেয়ারম্যান পাড়ার বাসিন্দা নিজাম উদ্দিনসহ আরো অনেকে বলেন, আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ থাকলেও রাস্তা বা গোরস্থানে কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না। গত বছর থেকে পৌরসভার মাধ্যমে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে গ্রামের রাস্তায় স্ট্রিট লাইট দেওয়া হয়েছে। এতে গ্রামের চিত্রটা পাল্টে গেছে।
রুপসীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মার্মা বলেন, শুধু অন্ধকার নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা এ জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে অবদান রাখছে বিনামূল্যের এই সৌর বিদ্যুত। সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে শিক্ষার্থীরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার মান উন্নয়নে। শিক্ষার্থীদের কাছে রাতের বেলায় পড়াশোনার জন্য হারিকেন ও কুপি বাতির পরিবর্তে এখন সোলার বাতি ব্যবহার করছেন। সৌর বিদুতের কারণে গ্রামীণ জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোবাইল, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্বাস্থ্য সেবাসহ নানা সুযোগ সুবিধা। মানুষের এখন আর শহরে যেতে হয় না ইন্টারনেট সুবিধার জন্য। ইউনিয়ন পরিষদ এবং ব্যক্তিগতভাবে ইন্টারনেট সুবিধা ছড়িয়ে পড়েছে অবহেলিত দুর্গম পাহাড়ে।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুরের একান্ত প্রচেষ্টায় ইউনিয়নের হেডম্যান, কারবারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান, ক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে সৌর বাতি বিনামুল্যে প্রদান করা হয়েছে। সৌর বিদ্যুতের আলোয় দূর হয়েছে দুর্গমতা।
সরেজমিন লামা পৌরসভা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মেঠোপথে স্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু জায়গায় কাজ চলছে। এ পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম জানান, তার এলাকার মধ্যে যেখানেই মানুষের চলাচল রয়েছে সেসব স্থানেই সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে আলো পৌঁছানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত পৌরসভা এলাকায় উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৪০টি সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রকল্পের আওতায় আরও বেশ কয়েকটি স্থানে সোলার স্ট্রিট স্থাপনের কাজ চলছে। রাস্তাগুলো আলোকিত হওয়ায় রাতে অপরাধ প্রবণতা কমে এসেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বিন মোহাম্মদ ইয়াছির আরাফাত বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে সারা দেশে গ্রাম-গঞ্জে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তার অংশ হিসেবে ২০১৬ সাল থেকে প্রকল্পটির যাত্রা বান্দরবানেও শুরু করা হয়। এ সৌর বিদ্যুতের কারণে একদিকে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রামের মানুষ অন্ধকার থেকে আলোকিত হয়েছেন।
তিনি আরো বলেন,গত পাঁচ বছরে বান্দরবান সদর, লামা, বলিপাড়া, থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি ও আলীকদম উপজেলার দুর্গম এলাকাকার লক্ষাধিক লোক বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে স্বাভাবিক বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব নয় এমন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম এলাকাসমূহে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই কর্মসূচি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হলে পাহাড়ের প্রতিটি পাড়া ও গ্রাম আলোকিত হওয়ার পাশাপাশি ধান ভাঙানোসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে লামা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মোহাম্মদ ইসমাইল জানান, দুর্গম পাহাড়ি এলাকার হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদ সব জায়গায় এখন সৌর বিদ্যুৎ বসানো হয়েছে। সৌর বিদ্যুতের কারণে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে মানুষ, ধীরে ধীরে এর চাহিদাও বাড়ছে।
সম্প্রতি বিদায়ী বান্দরবান জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন বলেন, সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই এখন ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে পাহাড়ে বসেই। জেলা বা উপজেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া অনেক সময় সম্ভব হয়নি। কিন্তু সৌর বিদ্যুতে এসব মানুষের দীর্ঘ দিনের সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে।

আরও পড়ুন