কোন মানুষকে জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পরে মুল্যায়ন এবং অতি মুল্যায়নের মধ্যে; এক ধরনের অনৈতিকতা বা আপোষকামীতার প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যক্তি শৈলেন’দা অন্য এক মানুষ ছিলেন। তাঁকে যাঁরা কাছে-দূরে থেকে অবলোকন করেছেন, তাঁদের কাছে এই প্রশ্নটি বেজায় অবান্তর ঠেকবে, স্বাভাবিক। কারণ তিনি আসলেই অন্য এক তরিকার মানুষ ছিলেন।
কেনো তিনি গুরুত্বপূর্ন অথবা মৃত্যুর পরও প্রাসঙ্গিক, বিষয়টি জানতে যেতে হবে কিছুটা পেছনে এবং তাঁর জীবিত বন্ধুদের কাছেই।‘অজাত শত্রু’ বলে একটা কথা বাংলা অভিধানে প্রচলিত আছে। এই শব্দবন্ধ সবার জন্য প্রযোজ্য নয় বলেই মানুষ মৃত্যু’র পরও তাঁর নিজের প্রজন্ম এবং উত্তর প্রজন্মের কাছে অমিত চিন্তার খোরাক হয়ে উঠেন।
রাঙ্গামাটির প্রয়াত সাংবাদিক শৈলেন দে; তেমনিই এক বন্ধুবৎসল, আজন্ম শত্রুহীন মানব মিত্র। দেশের সব এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া যাবে একাত্তরের অনেক শহীদ পরিবার। তবে তা খুব বেশী নয়। কিন্তু পাহাড়ে কয়টি পরিবার পাওয়া যাবে যাঁরা, একসাথে পরিবারের চার/পাঁচজন স্বজনকে হায়েনার হাতে হারিয়েছেন? অথবা এমন অসামান্য পারিবারিক অবদানের পর রাষ্ট্রীয় সুবিধা হাসিল করেননি?
এখন থেকে ৪২ বছর আগে বাবা মনোরঞ্জন দে, কাকা ডা. প্রিয়রঞ্জন দে এবং কাকাত ভাই অতিন্দ্র লাল দে ও নৃপেন্দ্র লাল দে (বাক-প্রতিবন্ধী); শহীদ হয়েছেন। শৈলেনদা’র মৃত্যুকালীন বয়স থেকে ৪২ বছর বাদ দিলে বাকী থাকে মাত্র কৈশোর। একটানা এতোটি বছর তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন, শোকের জগদ্দল পাথর। আজ খুব লজ্জা লাগছে, একজন সর্বত্যাগী শোকাতুর জীবনবাহী মানুষের মৃত্যু’র পরে তাঁকে নিয়ে ভাবছি।
এই লজ্জা কী, আমার একার? হয়তো এটাই সত্যি যে, যিনি নীরবে বহন করেছেন শোকের পাহাড়, আর তাই আমরাও বয়ে বেড়াচ্ছি প্রায়শ্চিত্তের নান্দীপাঠ। কিন্তু কোনটাই যেনো সত্যি নয় আজকের সময়ের নিক্তিতে। তাঁর স্মৃতিকথন নিয়ে প্রথম লিখেন, বন্ধু ও সহকর্মী সাংবাদিক সত্রং চাকমা। তিনিও ভুলে গেছেন হয়তো সে শুভক্ষণের কথা। সত্রং চাকমা’র সেই আবেগঘন-স্মৃতি অনুলিখনটি প্রকাশিত হয়েছিলো বিগত ২০১০ সালে ‘উত্তরাধিকার ৭১’ নামের একটি ঋদ্ধ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংকলনে। প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রবীর সিকদার সম্পাদিত সেই সংকলনের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন, আমারই কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোসেন শহীদ মজনু।
প্রকাশনাটি আমার হাতে আসার পর পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে তাঁকে (মজনু) একবার ফোন দিয়েছিলাম। সে আমার কাছে একবুক অতৃপ্তি প্রকাশ করেছিলো। বলেছিলো, তোমরা পাহাড়ে, আসলেই কী করো? মজনু, দাবী রেখেছিলো; পাহাড়ে মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের ইতিহাস যেনো সংরক্ষিত হয়, আরো বেশী বিকশিত জ্ঞানের প্লাবনে। ইচ্ছে করছিলো, মজনুকে বলি; তোমার সেই ‘শৈলেন দেঃ একাত্তরে হারান বাবা-কাকাসহ প্রিয় চার স্বজনকে’ শিরোণামে প্রকাশিত নিবন্ধের মহানায়ক হারিয়ে গেছেন।
শৈলেনদা’কে জানতে এবং বুঝতে আমার বেশ ক’বছর সময় লেগেছিলো। আর তাই তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর সর্ম্পকে কলম ধরতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। বেশ ক’জনকে ফোন দিয়েছিলাম, জীবিত শৈলেন দে এবং মৃত শৈলেন দে’র কর্মকৃতি জানতে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সেসব ফোনের সবক’টি জবাব সুখকর হয়েছে বলা যাবেনা।
কোন কোন ফোনের জবাব,আমার জন্য ‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’-এর চেয়ে ভারী মনে হয়েছে। একজন ‘অজাত শত্রু’ মানুষের মৃত্যু’র পর তাঁর প্রতি কোন সহকর্মী বা বন্ধু ও স্বজনের শ্রবণ অযোগ্য উক্তি উচ্চারণ! পরম করুণাময়ের দোহাই দিয়ে বলছি, এমনিই ক্ষমার অযোগ্য কথাও হজম করতে হয়েছে; এই আমাকে। তাতে কী প্রয়াত শৈলেন দে’র আত্মার স্বর্গ-নরক নির্ধারণ হবে। মোটেই না। আমি বিশ্বাস করি, ব্যক্তি মরে গেলেও তাঁর কর্ম এবং দর্শন-ই মানুষটিকে প্রজন্মের কাছে জীবিত-অক্ষয় করে রাখে।
তাই ফোন দিয়েছিলাম, রাঙ্গামাটির বর্ষীয়াণ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে’কে। যিনি নিজেও সাহসী সাংবাদিকতার জন্য পাহাড়-সমতল ছাপিয়ে বয়েসী দ্রোহের এক আলোকিত মানুষ।
প্রয়াত শৈলেন দে’র ভাতৃপ্রতিম স্বজন এবং বয়সে প্রায় এক দশকের বড়ো। সুনীল’দা অকপটে স্বীকার করলেন, ব্যক্তি শৈলেনের অকাল মৃত্যু রাঙ্গামাটি’র মতো পুরনো শহরের বুদ্ধিবৃত্তিক বিশাল এক শূন্যতা, যা পূরণ হতে অনেক বেশী সময়ের প্রয়োজন পড়তে পারে। সুনীল দে’র আক্ষেপটি যেনো বর্ণমালার ব্যঞ্জনায় ক্ষোভের মতোই শোনাচ্ছিল। টেলিফোনের অপর প্রান্তের দীর্ঘশ্বাস ছাপিয়ে কানে বাজছিল, শেষ বয়সে শৈলেন কর্মহীন হয়ে পড়েছিলো’। তারপর ফোনটি কেটে দিয়ে, নিজেও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিজের কাছেই কোনো জানি শংকার মতো শঙ্খধ্বনি বাজছিলো; আসলেই কী মফস্বল সাংবাদিকতার পরিণিতি এমনিই? যখন শক্তি ও শ্রম বিকোবার সাধ্য থাকবেনা, তখন ভুলে যাবে সব বন্ধু?
সুনীল কান্তি দে; প্রয়াত শৈলেন দে’র কাছের আত্মীয় হলেও একে-অপরের চিন্তা ও কর্মের ঠিকানা সব-সময়ই আলাদা ছিলো। রাজনীতি-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং জীবন লড়াইয়ের গতিধারায় তাঁরা ছিলেন, স্বাধীন এবং স্বকীয়। সুনীল’দা জানালেন, শৈলেনকে কখনো নতজানু বা দুর্বল হতে দেখেননি; জীবনের কঠিন সময়েও। প্রয়াত শৈলেন দে’র বন্ধু বৈচিত্র্য বড়োই বিশাল। কী পাহাড়ি, কী বাঙালি; তাঁর কাছে মানুষ ও বন্ধুত্ব ছিলো, নিতান্তই চিন্তা ও দর্শনের মাপকাঠিতে মাপা।
তিনি কারো সাথে ভুল করে কর্মের সংসার গড়লেও ছাড়ার পরে বুঝিয়ে দিতেন, তিনি ভুল করেছেন। শুধু তাই নয়, জীবনের করুণতম পরিস্থিতিতেও আর তাঁদের নাম মুখে নিতেন না। রাঙ্গামাটির তরুণতম সাংবাদিক এবং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফজলে এলাহীর সাথে তিনি ঘাঁটছড়া বেঁধেছিলেন, আদর্শ আর তারুণ্যের টানে। সময়টা ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ‘দৈনিক রাঙ্গামটি’ পত্রিকায়।
ফজলে এলাহী শৈলেনদা’র স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি কাউকে শত্রু ভাবতেন না। আর শত্রু ভাবলেও তা কাউকে বুঝতে দিতেন না। তাঁর ভেতর শত্রুতার মতো ইন্দিয়শক্তি লুকিয়ে অথবা সংযম করার অসামান্য শক্তি ছিলো।
‘সংবাদ রসায়ন’ বলে বিশ্ব মিডিয়ায় এবং উন্নত সাংবাদিকতায় একটি কথা প্রচলিত আছে। এটি অনেকটা উৎকর্ষতাপূর্ন সাংবাদিকতার অনুষঙ্গ বলেও বিবেচিত। সম্ভবত এই উচ্চ মার্গীয় শব্দটি আমি প্রথম তাঁর কাছেই শুনেছিলাম। কিন্তু সেই শৈলেন’দা, জীবনের রসায়নেই হেরে গেছেন।
ফজলে এলাহীর সূত্র ধরে পাহাড়ের সম-সাময়িক বিষয় নিয়ে আমার বেশ ক’টি লেখা ‘দৈনিক রাঙ্গামাটি’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো। লেখা প্রকাশের অনেক পরে দেখা হলেও শৈলেন দে, সেসব লেখার সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তি ধরিয়ে দিতের অসামান্য নৈপূণ্যে।
তাই ফোন দিয়েছিলাম ফজলে এলাহীকে। তিনি জানালেন, প্রয়াত শৈলেন দে মানুষ হিসেবে, বন্ধু ও অগ্রজ হিসেব ছিলেন অমিত প্রাণোচ্ছল। ‘দৈনিক রাঙ্গামাটি’ পত্রিকায় ফজলে এলাহীর সাথে কাজ করার সময় শৈলেন দে’র মাথা-ব্যথার বড়ো কারণ ছিলো বাংলা বানান আর শব্দ চয়ন। তিনি সংবাদের ভাষা ও বোধগম্যতার সারল্য নিয়ে বেশী মাথা ঘামাতেন। এখনকার সংবাদপত্রে যে বিষয়গুলো অনেক বেশী গুরুত্ববহ, শৈলেন’দা অনেক আগে থেকেই তা জানতেন এবং বুঝতেন।
আর এ কারণেই তিনি সাংবাদিকতার রাজ্যে আসার আগে ব্যক্তি জীবনের রুচি ও সম্পন্নতাকে প্রাধান্য দিতেন। শৈলেন দে’র অন্যরকম এক অকৃত্রিম বন্ধু প্রতিম রায় পাম্পু। এসময়কার সাংবাদিক, এখন পেশায় আইনজীবি। পাম্পুদা’র সাথে তাঁর সর্ম্পকটা একেবারেই আদর্শিক এবং আত্মিক। সবার কাছে তাঁদের দু’জনের আস্থা ও গন্তব্যের নৈকট্য বোঝা কঠিন ছিলো। শৈলেন’দা যখন দীর্ঘ জীবনের কর্মযোগ ‘গিরিদর্পণ’ ছাড়লেন; তখন সোজা থিতু হলেন বন্ধু পাম্পু’র এনজিও ‘কপো সেবা সংঘ’-য়েই।
বিগত ২০০৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকতার পেশাটাকে আড়ালে রেখে মনোযোগী হয়েছিলেন, বন্ধুত্বের উষ্ণতায়।
প্রতিম রায় পাম্পু আগের রাতে যা চিন্তা করতেন, পরদিন সকালে এসে তারই প্রতিধ্বনি শুনতেন শৈলেন’দার কাছে। একে-অপরের নৃ-তাত্তি¡ক দুরত্ব মুছে গেছে তো সেই কৈশোরেই।
পেশাগত এবং সৃজনশীলতার প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে পাম্পু বেছে নিলেন ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির প্রথাগত আইন সংকলন প্রকাশের। আর এই কাজে ছায়াসঙ্গী শৈলেন’দা। কবিতার মানুষ, নাটকের অভিনেতা আর আবৃত্তির সুপুরুষ শৈলেন’দা বিশাল এই দায়ভার মাথায় নিলেন অকপটে।
শেষতক শেষ-ই করলেন তা। হয়তো বা হাঁপিয়েই উঠেছিলেন। ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো’ এমন দায়িত্বে তিনি আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। হয়তো বা মৃত্যু প্রস্তুতির ডাকও পেয়েছিলেন। জীবনের শেষ ক’বছর একেবারেই স্বেচ্ছা গৃহবন্ধীত্বকে সাথী করে নিয়েছিলেন তিনি।
আমি যখন শনিবার সন্ধ্যায় এবং রাতে প্রতিম রায় পাম্পুকে ফোন দিয়েছিলাম, তখন তিনি ঢাকাতেই। নাম্বারটা সুনীলদা’র পরামর্শেই নেয়া, আবার তাঁরই পরামর্শেই কথা বলার প্রয়োজনীয়তা।
প্রথম পরিচয়েই প্রসঙ্গ জেনে তিনি স্বকন্ঠে আবেগী স্বাগত জানালেন শ্রদ্ধেয় পাম্পুদা। তিনি বললেন অবিরত। আমি শুনলাম মুগ্ধ হয়ে সদ্য প্রয়াত অগ্রজের জীবন ও কর্ম, জীবিত স্বজন পাম্পু’র কাছে। এ যেনো এক অন্যরকম অনুভুতি। গায়ের রোম শিউরে উঠছিলো। একজনমে একজন মানুষ রাঙ্গামাটির মতো বিশালাকার শহরের বন্ধ্যা সময়কে কিভাবে ভরিয়ে দিয়েছেন, সৃজন আর চেতনায়।
লেখক- প্রদীপ চৌধুরী: পাহাড়ের সংবাদকর্মী
(এই লেখাটি রাঙামাটির প্রতিথযশা সাংবাদিক শৈলেন দে মারা যাবার পর পর লেখা হয়েছিল)
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। পাহাড়বার্তার -এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য পাহাড়বার্তা কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।