হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার পরও থানচিতে অবাধে পাথর উত্তোলন

NewsDetails_01

থানচির ঝিড়ি থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে পাথর
আমাদের খালে এক সময় প্রচুর পরিমান পাথর ছিল,পাথর উত্তোলনের কারনে বিশুদ্ধ পানিয় জল ছাড়াও জীব বৈচিত্র কাঁকড়া, মাছ, চিংড়িসহ নানাবিদ খাদ্য সামগ্রী বিলুপ্ত প্রায়। কথাগুলো বলছিলেন,বান্দরবানের থানচির কাইতং পাড়ার বাসিন্দা ও থানচি সদর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার রাইক্লাং ম্রোসহ তার সাথে থাকা আরো ৪-৫জন। তারা আরো বলেন, পাথর উত্তোলন ও ভেঁঙ্গে নিয়ে গেলে এ অঞ্চলে কাইতং পাড়া বোর্ডিং পাড়া, কুংহ্লা পাড়া হাবরুং হেডম্যান পাড়া, চংরই পাড়াসহ থানচি সদর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডে আর থাকতে পারবেনা এখানে বসবাস করা স্থানীয় আদিবাসীরা। পাথর উত্তেলনের ফলে পরিস্থিতি এতোই খারাপের পথে যে ইতিমধ্যে অন্যত্র চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের।
বান্দরবানের থানচি উপজেলার সাঙ্গু নদীসহ ছোট বড় প্রায় ২০/২৫টি ঝিড়ির ঝর্ণা, খালে অবাধে চলছে পাথর ও বালির উত্তোলন প্রতিযোগীতা। প্রকাশ্যে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা এই প্রতিযোগীতায় নামছে। পাহাড়ে ঝিড়ি ঝর্ণা পাথর উক্তোলনে প্রশাসনে নজর পড়লেও এরিয়ে যাওয়ার কারনে বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, অন্যদিকে পকেট ভারী করছে সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতিক কালে হাইকোর্ট বান্দরবানে পাথর উত্তোলনের উপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও সে আদেশ মানা হচ্ছে না। পাথর ও বালির উত্তোলনের ক্ষেত্রে পার্বত্য অঞ্চলেন আইন অনুযায়ী উপজেলা প্রশাসন ( ইউএনও) বন বিভাগ কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের সমন্বয়ে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারীকে নির্দিষ্ট জায়গা (যেখানে জনবসতিপূর্ণ নয়, পানির উৎস প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় সে জায়গা ) হতে পাথর উত্তোলন করে সরকারের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার করার লক্ষ্যে আবেদন করা হলে আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত রিপোটের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে অনুমতি মিললে সে জায়গা থেকে পাথর বালির উত্তোলন করা যাবে। কিন্তু বান্দরবানে থানচি উপজেলায় সেই আইন অমান্য করে উত্তোলন করা হচ্ছে পাথর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,বলিপাড়া ইউনিয়নে ৩৬১ নং থাইক্ষ্যং মৌজার অংশ হতে হাইলমারা পাড়া ঝিড়ি, দাকছৈ পাড়া ঝিড়ি, কমলা বাগান ঝিড়ি, ভরট পাড়া ঝিড়ি, ঙাইক্ষ্যং ঝিড়ি,শিলা ঝিড়ি, কানাজিও পাড়া ঝিড়ি, দিংতে পাড়া ঝিড়ি, মগকক্রী ঝিড়ি হতে বিগত ২০১৩ সাল হতে অদ্যবধি পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ঘনফুট পাথর উক্তোলন করে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ঐ সব ঝিড়িগুলির আশেপাশের পাড়াগুলিতে এখন পানির জন্য হাহাকার।
সরেজমিনে জানা যায়, ৩৭০ নং পদ্দা মৌজা অংশ পর্দ্দা ঝিড়ি (পাদাক), বাসিরাং পাড়া ঝিড়ি, কলা বাগান ঝিড়ি ও ছোট বড় ১০টি ঝিড়ি , ৩৬০ নং কোয়াইক্ষ্যং মৌজা অংশ সেগুম ঝিড়ি, নকথাহা ঝিড়ি, ক্যুটক্ষ্যং ঝিড়ি, ছাংদাক ঝিড়ি, মেকহা ঝিড়ি, টুকতং পাড়া ঝিড়িসহ ১০/১২টি ঝিড়ি ও ৩৬১ নং থানচি মৌজা থানচি হেডম্যান পাড়া ঝিড়ি ,অংপুং পাড়া ঝিড়ি, ছোট ইয়াংরে পাড়া ঝিড়ি, দুকলোক ঝিড়ি, নারিকেল পাড়া ঝিড়ি, নাইন্দারী পাড়া মগক ঝিড়িসহ ৮/৯টি ঝিড়িতে বিগত ২০১৫ সাল থেকে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।
পাথর ব্যবসার সাথে জড়িত দাকছৈ পাড়া বাসিন্দা উচনু মারমা ও অংছেন মারমা বলেন,পাথর রয়েছে এমন ঝিড়ি আমরা পছন্দ হলে পাড়ার প্রধান (কারবারী)কে প্রতি মন ১০ টাকা দরে আনুমানিক ৫০/৬০ হাজার টাকা অগ্রিম দিতে হয়। মৌজা হেডম্যানকে ২০/৩০ টাকা হারে ১ লক্ষ বা ২ লক্ষ টাকা অগ্রিম দিতে হয়। তারপর পাথর শ্রমিকদের অগ্রিম দিয়ে সংগ্রহ ও উত্তোলনের ব্যবস্থা গ্রহন করি। পরে প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন শৃংঙ্খলা বাহিনীতো আছে, পরে তাদের ম্যানেজ করতে প্রাথমিকভাবে প্রস্তুতি নিতে ৫ লক্ষ টাকা প্রয়োজন হয় ।
স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বলেন, সাংগু নদীর উপর বয়ে যাওয়া বালি গুলি সরকারি সম্পদ সে জানেন না। তবে চলতি বছরে মায়া গেষ্ট হাউজের মালিক আবদুর রহিম নিকট হতে আমতলী পাড়া স্থল তার বন্দোবস্তি জায়গা থেকে এক বছরে জন্য ২ লক্ষ টাকা দিয়ে ক্রয় করেন, লিজ নেন। পরে সরকারি দলের প্রধান, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ হওয়ার পর্যন্ত ৩/৪ লক্ষ টাকা অগ্রিম খরচ করার পর বালি উত্তোলন করেন বলে জানা যায় ।
থানচির ঝিড়ি থেকে পাথর উত্তোলনের ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
সম্প্রতি থানচি উপজেলা সদর হতে লিটক্রে পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ ৮০ কিলোমিটার বাস্তবায়ন কাজ চলমান রয়েছে। থানচি হতে লিটক্রে পর্যন্ত সড়কে নির্মাণ কাজে প্রথম ধাপে ৫ কিলোমিটার কাজের নিয়োজিত ঠিকাদার সংস্থা এনএন বিল্ডার্সের প্রকল্প ম্যানেজার ও সাইট ইজ্ঞিনিয়ার ওমর ফারুক জানান, প্রতি কিলো পাথর ৪৫ হাজার ঘনফুট, ইটের কংক্রিট ৪০ হাজার ঘনফুট, দেড় লক্ষ ঘনফুট বালির প্রয়োজন হয়েছে । স্থানীয়ভাবে সরবরাহকারী হিসেবে তিনজনকে নিয়োগ করছি ,তারা হলেন দখি ট্রেডার্স মালিক উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রনি মার্মা, কবীর কনষ্ট্রাকশন স্থানীয় বিএনপি নেতা ও থানচি বাজার পরিচালনা কমিটি সাবেক সম্পাদক, জসিম উদ্দিন ও অপর একজন জেএসএস এর প্রভাবশালী নেতা। তিনি আরো জানান, এনএন বিল্ডার্স কোম্পানির পরিচালক নাছির উদ্দিন মানিক স্যারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে তাদের। তার জানা মতে, ০ কিলো থেকে ৫ কিলো মধ্যে প্রতি ঘনফুট পাথর সরবরাহকারীকে ১৮০ টাকা, বালির ২৬ টাকা কোম্পানি তাদের দেয় ।
জানা যায়, থানচি উপজেলা সদর হতে লিটক্রে পর্যন্ত সড়ক নির্মানের সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রনালয় হতে সরাসরি সেনা বাহিনীকে বাস্তবায়ন কাজ করতে দিলে ও সেনাবাহিনী হতে ০ কিলো হতে ৫ কিলো পর্যন্ত এনএন বিল্ডার্স, ৬ হতে ৭ কিলো পর্যন্ত জিয়া উদ্দিন কস্ট্রাশন ধাপে ধাপে ৭/৮জন ঠিকাদার বাস্তবায়ন কাজ করছে ।
আরো জানা যায়, প্রধান সরবরাহকারী তিনজন এর ৩/৪টি সিন্ডিকেট রয়েছে, তাদের মধ্যে উচনু মারমা, মালিরাং ত্রিপুরা, চিংক্য মারমা, এমংউ মারমা, মংব্রাসে মারমা, রেমং মারমা, আবদুল কুদুজ, বেলাল হোসেন,অংছেন মারমা, সম্পদ ম্রো, শৈচিং মারমা, লুচাম ম্রো, মংহাই মারমা, থোয়াই প্রু অং মারমা সহ ২৫/৩০ জন সরবরাহকারী রয়েছে বলে এলাকাবাসীদের জানা যায়।
স্থানীয়রা মনে করেন, দ্রুত এই ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে থানচি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জল সংকটের পাশাপাশি ঝিড়িঝর্ণা থেকে হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র।

আরও পড়ুন