অতি দরিদ্রদের জন্য সুখবর

NewsDetails_01

২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি গ্রাম ও শহরকে দারিদ্র্য ও ভিক্ষুকমুক্ত করতে সারা দেশে সমন্বিত সঞ্চয় সংগ্রহ ও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে সরকার। এ কর্মসূচির আওতায় দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা প্রতিটি গ্রাম ও শহরের প্রত্যেক পরিবারের ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কর্মক্ষম মানুষকে পছন্দমতো পেশায় প্রশিক্ষণ দিয়ে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হবে। এক বছর মেয়াদি এসব ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১২ কিস্তিতে, যার প্রথম দুটি কিস্তি দিতে হবে না। যতদিন পর্যন্ত কোনো পরিবার দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে না উঠবে, ততদিন ঋণ দেওয়া হবে। খুব শিগগির দেশের আটটি বিভাগের আট উপজেলায় পাইলট ভিত্তিতে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের পর আগামী ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হবে। শুরুতে প্রত্যন্ত দরিদ্র গ্রামাঞ্চল, পশ্চাৎপদ এলাকা, হাওর, চর এলাকাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

কর্মসূচির আওতায় গ্রামে ও শহরে কর্মদল গঠন করে তাদের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহের পাশাপাশি ঋণ বিতরণ করবে সরকার। এসব ঋণের বিপরীতে কোনো সুদ নেবে না সরকার, শুধু সার্ভিস চার্জ নেওয়া হবে। ফলে গ্রামীণ ব্যাংক বা অন্য কোনো বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ে ঋণ সুবিধা পাবে দরিদ্ররা। শুরুতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বছরে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা আয়ের মানুষদের। পর্যাপ্ত বরাদ্দ সাপেক্ষে ঋণ দেওয়া হবে বছরে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত আয় রয়েছে এমন পরিবারকেও। ঋণের সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে দুই লাখ টাকা। একজন একই সময়ে দুটি ঋণ বা চার লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। ঋণ দেওয়ার আগে গ্রহীতাদের বিভিন্ন আয় উৎসারী বিষয়ে প্রশিক্ষণও দেবে সরকার।

এসব বিধান রেখে ‘জাতীয় সমন্বিত সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা ২০১৯’ প্রণয়ন করছে সরকার। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিচালিত সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক কর্মসূচির সমন্বিত বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে, যার একটি কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের (সমন্বয় ও সংস্কার) নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি জাতীয় সমন্বিত সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক কমিটি কাজ করছে। আগামী ২৮ মে ওই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে।

ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ ও সঞ্চয় কাজে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হবে। জেলার মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র এসব কমিটিতে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবেন। কমিটিগুলোর প্রধান হবেন সংশ্লিষ্ট এলাকার শীর্ষ কর্মকর্তারা।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. নাসির উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় এনে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম একই ছাতার নিচে আনার দিকনির্দেশনা দেন। তার প্রেক্ষিতেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে সমগ্র দেশের প্রতিটি গ্রাম থেকে শহর এলাকাকে সুসংগঠিত, টেকসই, আত্মনির্ভরশীল, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত এবং ভিক্ষুকমুক্ত এলাকায় রূপান্তর করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত সম্মতি রয়েছে। সারা দেশের গ্রাম ও শহর এলাকাকে পর্যায়ক্রমে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যেই এই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বার্ষিক আয়ের ভিত্তিতে সারা দেশের দরিদ্র পরিবারগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হবে। যাদের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা, তারা ক শ্রেণিতে, যাদের আয় এক লাখের বেশি দুই লাখ পর্যন্ত, তারা খ শ্রেণিতে এবং দুই লাখ টাকার বেশি থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের পরিবারগুলোকে গ শ্রেণিতে বিন্যাস করা হবে। ঋণ বিতরণে ক শ্রেণিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া গেলে গ শ্রেণিকেও ঋণ দেওয়া হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতিটি গ্রামে সমন্বিত সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব গ্রামকে সম্পূর্ণরূপে দারিদ্র্য ও ভিক্ষুকমুক্ত গ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে।

NewsDetails_03

খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রথমে গ্রামে, পরে ইউনিয়নেÑ এভাবে প্রতিটি উপজেলা দারিদ্র্য ও ভিক্ষুকমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচিত গ্রামে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের দারিদ্র্য মানচিত্র অনুসারে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী প্রতিটি মানুষকে চিহ্নিত করে তাদের পছন্দমতো পেশার ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্লাস্টারে ভাগ করে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এর আওতাভুক্ত করা হবে।

উদাহরণ দিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, কোনো একটি গ্রামে দারিদ্র্যসীমার নিচে ৩০০ ব্যক্তি থাকলে তাদের মধ্যে ৫০ জন হাঁস-মুরগি পালন করতে চান। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার বাজেটে এ খাতে ৩০ জনের ঋণের সংস্থান রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ বিভাগ ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মধ্য থেকে ৩০ জনকে ঋণ দেবে। বাকি ২০ জনকে ঋণ দেবে সমাজসেবা অধিদপ্তর। অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বরাদ্দের ঘাটতি থাকলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বরাদ্দ হতে তা পূরণের মাধ্যমে সমন্বিত সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করা হবে। স্ব স্ব দপ্তর তাদের ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা নেবে। প্রয়োজনে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় আলাদা প্রকল্প হাতে নেবে।

কর্মদল গঠন সম্পর্কে খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিটি এলাকায় ক ও খ শ্রেণিভুক্ত পরিবার হতে প্রতিনিধি নিয়ে ২০-২৫ সদস্যের পেশাভিত্তিক কর্মদল গঠন করা হবে। দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে এমন পরিবারের ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যেকোনো কর্মক্ষম ব্যক্তি কর্মদলের সদস্য হতে পারবে। দলনেতা বা তার সহকারী আদায় করা সঞ্চয় ও ঋণের কিস্তি আদায় করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা দেবেন। ঋণ দেওয়া হবে পেশা অনুযায়ী। বাদাম বিক্রি, গবাদিপশু কেনা, হাঁস-মুরগির খামার করতে বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইউনিয়ন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঋণ দেওয়া হবে। তবে ঋণের পরিমাণ দুই লাখ টাকার বেশি হবে না। ১২ কিস্তির মাধ্যমে বা উপজেলা কমিটি নির্ধারিত কিস্তি অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ করতে হবে। প্রথম দুটি কিস্তি গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ, প্রথম দুটি কিস্তি দিতে হবে না। কোনো ব্যক্তি সময়মতো নির্ধারিত কিস্তি না দিলে তা আদায়ে উপজেলা কমিটি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণের শতভাগ অর্থ ফেরত দেওয়ার পর নতুন ঋণ নিতে পারবেন। এভাবে স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত কোনো সদস্যকে ঋণ দেওয়া অব্যাহত রাখা হবে।

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, দলভুক্ত সদস্যদের সঞ্চয় তাদের ব্যক্তিগত আমানত হিসেবে বিবেচিত হবে। বছরান্তে দলের সদস্যরা নিজ নিজ সঞ্চয় ফেরত নিতে পারবেন। প্রত্যেক সদস্য তার সঞ্চয়ের বিপরীতে ব্যাংক সুদ পাবেন। কোনো সদস্যের সঞ্চয়ের মেয়াদ এক বছর না হলে তিনি সঞ্চয়ের আসল অর্থ পাবেন, কোনো লাভ পাবেন না। কোনো সদস্যের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকাররা আসল ও লভ্যাংশ পাবেন।

জাতীয়ভাবে ক্ষুদ্রঋণ সমন্বয়ে ৯ মন্ত্রীকে নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা কমিটি কাজ করবে, যার আহ্বায়ক হবেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের (সমন্বয় ও সংস্কার) নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি জাতীয় সমন্বিত সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক কমিটি থাকবে। এই কমিটি বেইজলাইন সার্ভে করে গ্রামের উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়ন ও কার্যক্রম পর্যালোচনার নির্দেশনা দেবে। একজন ব্যক্তি যাতে দুটির অধিক ঋণ না পায় এবং অতিদরিদ্র ও দরিদ্র সব ব্যক্তি ঋণ ও প্রশিক্ষণ পায় কমিটি তা নিশ্চিত করবে। এ ছাড়া, ঋণ মওকুফ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তদারকি করবে এই কমিটি।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলার সব সংসদ সদস্যকে নিয়ে প্রতিটি জেলায় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে। জেলা উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি হবেন ওই জেলার মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা উপদেষ্টা। কোনো জেলায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা উপদেষ্টা না থাকলে ওই জেলার জ্যেষ্ঠ কোনো সংসদ সদস্য কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করবেন। তবে জেলা সমন্বিত সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক কমিটির প্রধান হবেন জেলা প্রশাসক। পুলিশ সুপারসহ জেলা পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ নির্বাহীরাও থাকবেন কমিটিতে। একইভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে উপজেলা সমন্বিত সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ বাস্তবায়ন কমিটি কাজ করবে, যেখানে উপজেলার সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ উপজেলা পর্যায়ে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা থাকবেন। উপজেলার সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এই কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবেন। প্রতিটি সিটি করপোরেশন এলাকায় সাত সদস্যের একটি কমিটি কাজ করবে। কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন ওই সিটি করপোরেশনের মেয়র। ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে কমিটির সভাপতি হবেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র।

এসব কমিটি বিভিন্ন বিভাগের সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে দ্বৈততা পরিহার করতে ঋণ গ্রহণে উপযুক্ত ব্যক্তিদের তথ্যভা-ার গড়ে তুলবে। বিতরণ করা ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি-না, তা দেখভাল করবে। ঋণ আদায় না হলে তা আদায়ের ব্যবস্থা করবে। এই কমিটি আওতাধীন পুরো এলাকাকে দারিদ্র্যমুক্ত এলাকায় পরিণত করবে। এছাড়া কমিটি ঋণগ্রহীতার মৃত্যু বা শারীরিক অক্ষমতা বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে ঋণ পরিশোধে সামর্থ্য না থাকলে তার ঋণ মওকুফ করতে জাতীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করবে।

আরও পড়ুন