অসুস্থ খালেদা জিয়া, অসুস্থ রাজনীতি

NewsDetails_01

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া
বেগম খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে সুস্থ নন। কারোরই অজানা নয় এই তথ্য। কারাগারে যাওয়ার পরে অসুস্থতার মাত্রা বাড়বে, সেটাও খুব অস্বাভাবিক নয়। বিতর্ক চলছে ‘মাইল্ড স্ট্রোক’ না ‘সুগার ফল’ নিয়ে। দুপক্ষের বক্তব্য থেকেই অসুস্থতার বিষয়টিই উঠে এসেছে।

বাইরে যে পরিবেশে তিনি থাকতেন, তার সঙ্গে কারাগারের পরিবেশের কোনো তুলনা করা চলে না। দেশে এবং বিদেশে যে চিকিৎসা সুবিধা নিয়েছেন, কারাগারে তা পাওয়ার কথা নয়। তার চেয়ে বড় বিষয়, এখন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা কেমন, তিনি কতটা সুস্থ, কতটা অসুস্থ- তা নিয়ে যতটা ধোঁয়াশা আছে, ততটা তথ্য নেই।

খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকেরা কারাগারে দেখা করে এসে বললেন, ‘তার মাইল্ড স্ট্রোক করেছিল। তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।’

মামলা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক যাই থাকুক, এটাই সত্যি যে বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া শাস্তি পেয়েছেন, কারাগারে আছেন। তিনি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান, শেষ হয়নি। এটা বেগম খালেদা জিয়ার একটি পরিচয়। এর বাইরে খালেদা জিয়া একাধিকবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আসনে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। কখনো পরাজিত হননি। সেক্টর কমান্ডার, সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী।

তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বা মামলার ক্ষেত্রে এসব পরিচয় গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়। অভিযোগ, মামলা বা রায় বিষয়ে কিছু বলছিও না। আদালতের মধ্য দিয়েই তা নির্ধারিত হবে। বলছি রায় পরবর্তী অবস্থা ও তার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়ে।

বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুন মেনেই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার চাইছে তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে এনে চিকিৎসা করাতে। বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নয়, ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে চান। ফলে তাকে আনা হয়নি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে।

প্রশ্ন এসেছে, দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারদের একটা অংশ তো বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে কর্মরত। তাহলে সেখানে চিকিৎসা নিতে সমস্যা কোথায়? তাছাড়া জেল কোড অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার নিয়ম।

এক্ষেত্রে প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের মান নিয়ে নয়। প্রশ্ন হলো, একজন রোগীর ইচ্ছে বা স্বস্তিবোধের। তিনি যে ডাক্তার, যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ইচ্ছুক, তার চিকিৎসা সেখানেই হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সামনে আসছে জেল কোডের প্রসঙ্গ। জেল কোডে এ কথা বলা নেই যে, সরকারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে নেওয়া যাবে না। সরকার ইচ্ছে করলে, চিকিৎসার জন্যে যেকোনো হাসপাতালে নিতে পারেন। খালেদা জিয়ার ভাই ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসার ব্যয় বহন করতেও সম্মতির কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন।

তাছাড়া জেল কোড বা আইনের যে বাধ্যবাধকতার কথা বলা হচ্ছে, তা যে সব সময়ই মেনে চলা হয়- বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। ইয়াবা ব্যবসায়ী, হত্যা মামলার সুস্থ অপরাধীরাও মাসের পর মাস হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনে থাকে।

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল অবশ্যই একটি ভালো হাসপাতাল।

কিন্তু ‘আস্থা’ এবং ‘অনাস্থা’র মতো একটি বিষয় আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা বা ডাক্তারদের ক্ষেত্রে আছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ গুরুত্বপূর্ণ এই পেশাজীবীরাও রাজনীতির অংশে নিজেদের এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছেন যে, আওয়ামী লীগের ডাক্তার, বিএনপির ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছেন। ডাক্তাররা রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থেকে রোগী দেখেন বা চিকিৎসা সেবা দেন, এ কথা দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি। এসব ডাক্তাররা প্রতিদিন হাসপাতালে অসংখ্য রোগী দেখছেন, রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় নিচ্ছেন না। রাজনৈতিক পরিচয় বিএনপি, এমন ডাক্তারও আছেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে। তারপর কেউ যদি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে চিকিৎসা না নিতে চান, তার যদি আস্থায় ঘাটতি থাকে, অসুস্থতা বিবেচনায় তার ইচ্ছা বা মতামত গুরুত্ব পেতেই পারে।

২.

NewsDetails_03

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১/১১’র সময়ে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে কানের চিকিৎসার জন্যে আমেরিকা গিয়েছিলেন। তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশেই চিকিৎসা করানোর কথা বলেছিল, বিদেশে যেতে দিতে রাজি হতে চাননি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক যারা অত্যন্ত স্বনামধন্য তারা বারবার বলেছেন, সঠিক চিকিৎসার জন্যে বিদেশে যাওয়া দরকার। তখন এই অবস্থানের পক্ষে বলেছি, লিখেছি।

এখন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকেরা কারাগারে দেখা করে এসে বলছেন, তার মাইল্ড স্ট্রোক করেছিল। ডাক্তারদের এই বক্তব্য বা ধারণার পর রাষ্ট্রের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বললেন, ‘খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা অসত্য বলছেন। খালেদা জিয়ার মাইল্ড স্ট্রোক করেনি। উনার ‘সুগার ফল’ করেছিল।’

প্রথমত, অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ‘সুগার ফল’ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বক্তব্য তার দেওয়ার কথা নয়।

দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা কথা বলে এবং আনুষঙ্গিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে, ধারণা করতে পারেন যে তার ‘মাইল্ড স্ট্রোক’ করেছিল। ধারণা থেকে কী রোগ হয়েছে তা হয়ত বলা যেতে পারে, এত স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে কী রোগ হয়নি- পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া তা কি বলা যায়? তাছাড়া ‘সুগার ফল’ও বড় সমস্যায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

তৃতীয়ত, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের বক্তব্য সঠিক ধরে নেওয়ার দরকার নেই। মাইল্ড স্ট্রোক না সুগার ফল তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে প্রয়োজন ছিল অতিদ্রুত পরীক্ষা করা। তারপর কথা বলতে পারতেন, জেল কর্তৃপক্ষের পক্ষে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার।

চতুর্থত, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে যেহেতু রাজনৈতিক বিতর্ক আছে, ফলে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত একটা সংবাদ গণমাধ্যমকে জানাতে পারত, এখনও পারে।

৩.

নিয়মিত সংবাদ না জানিয়ে, রোগ যাচাইয়ের জন্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে, চলছে রাজনৈতিক তর্ক। আইন কর্মকর্তা দিচ্ছেন ডাক্তারের বক্তব্য। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরও যা বলার কথা নয়, তা বলছেন।

একজন মানুষ অসুস্থ। তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত, অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে তার প্রতি রাগ-ক্ষোভ থাকতে পারে। তার বিরুদ্ধে আছে প্রায় তিন ডজন মামলা।

এসব অভিযোগের বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। কিন্তু তাকে চিকিৎসা তো দিতে হবে। এটা তার অধিকার। একজন নারী, একজন সিনিয়র সিটিজেন, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, চিকিৎসা সেবা পাওয়া অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে রাজনীতিটা আরেকটু ‘সুস্থ’ হওয়া দরকার। একথা অস্বীকার করা যাবে না, শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে এখন যে ‘অসুস্থ রাজনীতি’ চলছে, সংবেদনশীলতাহীন কু-বিতর্ক চলছে, তা তৈরির পেছনে বিএনপি বা খালেদা জিয়ারও দায় আছে। প্রশ্ন হলো, এই ধারা কি অব্যাহত থাকবে না এর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে? কিন্তু সেই ধারা থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়।

রাজনীতিতে খুব বেশি রকমের ‘অসুস্থতা’ এবং দিন দিন আরও বেশি ‘অসুস্থ’ ধারায় প্রবাহিত হওয়াটা দৃশ্যমান।

প্রত্যাশা, রাজনীতি কি আর একটু ‘সুস্থ’ হতে পারে না! পারে না আর একটু মানবিক হতে!!সূত্র : দ্যা ডেইলি স্টার

আরও পড়ুন