একজন সাদাসিধা মানুষের কথা

NewsDetails_01

২০০৮ সালে ময়মনসিংহে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজে ভর্তি হই। ২০০৯ সালে কলেজ থেকে যখন মেসে যেতাম তখন মাঝে মাঝে দেখতাম কলেজ রোডে সাদাসিদে একটি একতলা বাড়ির চুনকাম করা হত, বাড়ির আশপাশের ঝুপ জঙ্গলা পরিষ্কার করে মশা মারার ওষুধ ও ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হত। নষ্ট লাইটগুলো খুলে নতুন লাইট লাগিয়ে চারপাশ আলোকিত করা হত। কোনো কারণ ছাড়াই শুধু একজন মানুষের আগমন উপলক্ষে ওই বাড়িটিতে নয়, কলেজ রোডের চারদিকে উৎসবের আমেজ চলে আসত। দু তিনজন পুলিশ বাড়ির প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে থাকলেও যে কেউ বাড়িতে ঢুকতে পারত, কোনো বাধা ছিল না। ‍রিক্সাওয়ালা চাচারা খুশি খুশি কণ্ঠে বলত, ‘সৈয়দ নজরুলের ছেলে মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ আইছে। বুঝছেন মামা, মন্ত্রী অইলে কিতা অইব, সহজ-সরল মানু! উকি মারলেই দেখবাইন লুঙ্গি পইরা বারিন্দাত বইয়া রইছে। সবার লগে গপ করতাছে।’

রিক্সাচালকের কথা শোনে প্রায় সময় উকি মারতে চাইতাম কিন্তু সাহসের অভাবে উকি মারতে পারি নাই। আবার চলে গেলে দেখতাম বাড়িটা ঠিক আগের মত নির্জীব পরে আছে। তবে আমার কাছে মনে হত, মানুষটা চলে গেলেও বিশাল ব্যক্তিত্বের কিছুটা নিয়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। শুধু মাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম থাকতো বলেই এমন মনে হত। এমন প্রবল ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। স্কুলের শিক্ষকরা বলতেন, বড় হয়ে এমন ব্যক্তিত্বের মানুষ হবি, যেনো রাস্তা দিয়ে হেটে চলে গেলেও মানুষ বুঝতে পারে এদিক দিয়ে একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষ হেটে গেছে। আমার মনে হয়, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমন বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের একজন ছিলেন।

শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ রেজাল্টের জন্য ময়মনসিংহ তো বটেই পুরো বাংলাদেশে খুব পরিচিত একটি কলেজ। শিক্ষার মান খুব ভালো হওয়ায় অল্প দিনেই সুনাম করে। কলেজটি খুবই স্বল্প জায়গার উপর কয়েকটি আধ ভাঙ্গা হাফ বিল্ডিং নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শোনা কথা, কলেজটির জায়গা বৃদ্ধি সহ অবকাঠামোগত কিছু সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নাকি সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘বাবার নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার জন্য ধন্যবাদ। এই মুহূর্তে সাহায্য সহযোগিতা দেওয়ার মত অবস্থা আমাদের নেই। তবে আমার বিশ্বাস, কলেজটি যে অবস্থায় আছে আপনাদের সহযোগিতায় এখান থেকেই সেরাসেরা শিক্ষার্থী বেড় হয়ে নানা জায়গায় জ্ঞান অর্জনের জন্য ছড়িয়ে পরবে।’ কলেজটি কিন্তু সেই আগের মতই আছে শিক্ষার মান একটুও কমেনি।

২০১৩ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি সংগঠিত গণজাগরণ মঞ্চ ও ৫ মে সংগঠিত হেফাজত ইসলামের মহাসমাবেশ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা। ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাসহ চিহ্নিত রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ছিল অহিংস। উল্টো দিকে, গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি আন্দোলনে গড়ে উঠা ৫ মের হেফাজত ইসলামের আন্দোলন প্রথম দিকে অহিংস থাকলেও পরে সহিংসতার রুপ নেয়। ঠিক সমাবেশ নয়, ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে গ্রামাঞ্চল থেকে ভুল বুঝিয়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জমাতে করা হয়েছিল মানুষদের। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু বিকালের পর সমাবেশ হঠাৎ করে ভয়ংকর রুপ ধারণ করে। সমাবেশে আগত মানুষ হুঠ করে সহিংস হয়ে রাস্তার গাড়ি ও ফুটপাতের বিভিন্ন দোকান ভাঙ্গচুর করে অগ্নিসংযোগ ঘটাতে থাকে। এর মধ্যে খবর আসে হেফাজতিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়ে ভাস্কর্য গুলোও ভেঙ্গে ফেলবে। টিভিতে সহিংসতার ছবি দেখে মনের ভেতর কিছুটা আশঙ্কা কাজ করছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমরাও অনড় ছিলাম।

এর মধ্যে খবর আসে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইলামের সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। আমরা সংবাদ সম্মেলনে দেখি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হেফাজতিদের বলছেন, আপনারা সমাবেশ করতে চেয়েছেন, সমবেশ করতে দেওয়া হয়েছে। এখন সমাবেশ শেষ হয়েছে প্রত্যেকে প্রত্যেকের মত বাড়ি চলে যান। আসলে এতটুকু আতঙ্কিত ছিলাম যে আমরা চাচ্ছিলাম কেউ ভরসা দিয়ে কিছু বলুক।

NewsDetails_03

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যখন অত্যন্ত শান্ত ভদ্র অথচ বলিষ্ঠ কণ্ঠে বাড়ি চলে যাওয়ার আহ্বান জানালেন তখন বুঝতে পেরেছিলাম আর তাদের সহিংসতা করার সুযোগ নেই। একটা কিছু হবেই। সত্যিকার অর্থেই হঠাৎ করে চলে আসা ভয় হঠাৎ করে কেটে গেল। এর পরে ইতিহাস সবার জানা, কত সহজেই এত বড় একটা সহিংসতা কোনো ধরণের রক্তপাত ছাড়াই বন্ধ হয়ে গেল। সেদিনের সেই সংবাদ সম্মেলনের সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চেহারা আমার চোখে এখনো ভাসে, কথাগুলো কানে বাজে। তিনি ছিলেন এমন ভরসার মানুষ।

একজন মানুষ ভালো কি মন্দ, তা অনেক সময় বোঝা যায় বিরোধী মতাদর্শের মানুষের মন্তব্যে। ২০১৮ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সুদীর্ঘ সাক্ষাতকার পড়েছিলাম। সেই সাক্ষাতকারে বিএনপি মহাসচিব কোনো এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অর্থবহ করতে সৈয়দ আশরাফ ব্যক্তিগতভাবে চেষ্ঠা চালিয়েছেন। উদ্যাগ সফল না হওয়ার পেছনে আমরাও দায়ি। কারণ আমরা তখন একটি রাজনীতিক দাবির প্রেক্ষিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের ফিরার সুযোগ ছিল না।’ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ব্যক্তিত্বের জোরেই হোক কিংবা ভিন্ন কোনো কারণেই হোক তিনি সৈয়দ আশরাফের রাজনৈতিক স্বচ্ছতার কথা অস্বীকার করতে পারেন নি।

প্রাথমিক বাছাইয়ের ভাইবায় আমাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন এক কর্নেল। ঠিক মনে নেই তবে অধিকাংশ প্রশ্ন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মুদ্রার নাম ও উপনিবেশ, এ জাতীয়। একটাও পারলাম না। কিছুটা মন খারাপ হল। ভাইবা বোর্ডের প্রধান এক বিগ্রেডিয়ার পদমর্যাদার অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলত দেখি জনপ্রশাসন মন্ত্রীকে? তখন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেন। আমি তো ধুম করে উত্তর দিয়ে দিলাম –সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। উনি বেশ খুশি হলেন। এবার জিজ্ঞেস করলেন তাঁর বাবার নাম এবং তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে? এরপর আমাকে আটকায় কে! নাম বলে শুরু করে দিলাম। এবার তিনি আমাকে থামিয়ে বললেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তো প্রধানমন্ত্রীর আন্ডারে থাকে। কেনো তাঁকে এই মন্ত্রনালয় ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে তোমার মনে হয়? উত্তরে শুধু বললাম, সততার পুরুস্কার! এই একটা কারণে তিনি আর কোনো প্রশ্ন না করে পরবর্তী পরিক্ষার জন্য আমাকে পারমিশন দিলেন। এই মুহূর্তে যদি জনতার সামনে প্রশ্ন রাখা যায়, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পরে কোন কোন রাজনৈতিক নেতা আপনার পছন্দের তালিকায় রয়েছে? আমার মনে হয় দ্বিতীয় নামটি উঠে আসবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের!

আমি এমন মানুষও দেখেছি রাজনীতির ধারের কাছে নেই, রাজনীতি মানেই তাদের কাছে নেতিবাচক ধারণা কিন্তু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সততা ও স্বচ্ছতা নিয়ে তাদের কোনো প্রশ্ন নেই। কোনো কারণ ছাড়াই তারা মানুষটাকে বিপুল ভালোবাসে সীমাহীন সম্মান করে। নিবৃত্তিচারী মানুষটি নিরবে ভালোবাসা এবং সম্মানটুকু বাঙালির কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন। এ জন্যই তিনি হারিয়ে যাবেন না।

সত্যিই রাজনীতিতে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক বিরল ব্যক্তিত্বের নাম। তিনি দেখিয়ে গেছেন রাজনীতি করে কিভাবে বিপুল মানুষের বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন করা যায়। শ্রদ্ধায় বিদায় নেওয়া যায়।

বিদায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

আরও পড়ুন