নিরঞ্জন ও মালাউন

NewsDetails_01

শেখ জায়েদ
শেখ জায়েদ
আমাদের পাশের ভিটায় একজন থাকতেন। নাম নিরঞ্জন মাস্টার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। তার ভিটার নামও মাস্টার ভিটা। ঘাড়টা একদিকে বাঁকা ছিলো। স্বনির্ভর মানুষ। বিরাট ফসলের মাঠ, এক বিশাল ভিটা উনার। দুধের গরু বেশ কয়েকটা। খুব যত্ন করতেন। তার একটাই দোষ ছিলো.. উনি নিজের ভিটায় কাউকে গরু চড়াতে দিতেননা। নিজেও কারো জমিতে চড়াতেন না। কারো কোন ক্ষতি কখনো করেছেন শুনিনি।
একটা ছেলে বেশ পড়াশুনা করিয়েছেন। জঙ ধরা ভাঙ্গা একটা সাইকেলে স্কুলে যেতেন। স্কুল থেকে এসে গরু চড়ানো। মাঠের গোবর পরিস্কার করা আর গাছের যত্ন করা ছিলো প্রতিদিনের কাজ। মাঝে মধ্যে তিন কোনা ঠেলা জাল দিয়ে বিল থেকে মাছ ধরতেন। উনার ভিটায় মাঝে মধ্যে হানা দিতো দুষ্টু ছেলের দল..আম আনতে। লাঠি নিয়ে তাড়া করতেন। আমার বিদ্যালয়ে যেতে হতো উনার ভিটের উপর দিয়ে। আমি কার ছেলে জানতেন, তবে আমার সাথে কথা হতোনা। উনার বউ ( কিউট একটা বুড়ি) ডাক দিয়ে বলতেন…. সব পোলাপান আম নেয় তুমি নেওনা ক্যা ? তারপর একটা বাজারের ব্যাগে ( সিমেন্টের বস্তা দিয়ে বানানো) করে কতগুলো আম দিলেন। আমার নিতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এখন মনে হয় দেড় মিনিটের রাস্তা। তখন পা ছোট ছিলো তো !!, এখন ভাবলে মনে হয়, বাচ্চাদের আম চুরিতেও উনারা বেশ আনন্দ পেতেন।
 প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিরঞ্জন মাস্টারের বাড়ি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিরঞ্জন মাস্টারের বাড়ি
উনাদের একটা জিনিষের প্রতি আমার খুব লোভ ছিলো। চলতে চলতে শুধু একটু থেমে দেখে দেখে যাওয়া আসা করতাম। সেটা হচ্ছে রক্তজবা, তার উপরে ফুলসহ কৃষ্ণচূড়ার গাছ। সেই লােল লাল দেখে আমার মাথাটা নষ্ট হয়ে যেতো। পাগল হয়ে যেতাম। মনে হতো যদি ওই লালে ঝাঁপ দিয়ে গড়াগড়ি খেতে পারতাম ! ইচ্ছেমতো গায়ে মাখতে পারতাম !!.. সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি কখনো।
একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ ছিলো ওটার নীচে দিয়ে চোখ বন্ধ করে গেলে পেটভরে ঘ্রাণ নেয়া যেতো।জানালা দিয়ে একটা মেয়ে আমাকে প্রায়ই দেখতো। উনি বোধহয় মাস্টার সাহেবের ভাতিজি লাগতেন। আমি ফোরের ছাত্র উনি বোধহয় আই এ পড়তেন। আমার এই ঘ্রাণ নেয়া দেখা আমাকে পাঁচটি ফুল দিয়েছিলেন পাতাসহ.. চুল বাঁধার রাবার দিয়ে পেঁচিয়ে। আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। নাক ডুবিয়ে গন্ধ খেয়েছি। একদিন শুনলাম নিরঞ্জন মাস্টারের সাথে নাকি জমি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে মেম্বার বাড়ির। কিছুদিন পর, উনি জমি বিক্রি শুরু করলেন। প্রথমে ধানি জমি, পরে ভিটা। সবশেষ বাড়ি ভিটাও বিক্রি করলেন। কিনেছে গার্মেন্টসওয়ালারা। শুনেছিলাম, ছেলে নাকি কলকাতায় চাকুরি করেন। সব বেচে পরিবার নিয়ে তিনি ভারতে চলে গেছেন।
নিরঞ্জন মাস্টারের বাড়িতে গার্মেন্টসওয়ালাদের নতুন ভবন
নিরঞ্জন মাস্টারের বাড়িতে গার্মেন্টসওয়ালাদের নতুন ভবন
অনেক দিন পর ( ৫-৬ বছর আগে) উনার ভিটায় গিয়ে ছিলাম তিনটি মাটির ঘরের চিহ্ন আছে। দেয়ালের ভগ্নাংশ আছে, একটি ঘর এখনো আছে। কারা যেনো গোয়াল ঘর হিসেবে ব্যবহার করছে। দুটো নারকেলের গাছ, আর ছাট থেকে বড় হয়ে যাওয়া কাটাওয়ালা (ক্যাকটাস) গাছ। ভিটের মাথায় নদীতে নুইয়ে পড়া ভুতুরে হিজল গাছটির একটা অংশ আছে। আর আছে শুধু একটি রক্ত জবা গাছ, কেউ যত্ন নেয়না। একটা পলিথিনে করে পাশের বিল থেকে পানি নিয়ে গোড়ায় দিয়েছিলাম। তারপর আর খোঁজ নেয়া হয়নি তার।
এখনো সবাই মাস্টার ভিটা নামেই ডাকে। গতকাল আবার গিয়েছিলাম রক্ত জবা গাছটি আর নেই। নদীটির অবস্থা খুবই খারাপ। নদীর জল গার্মেন্ট্সের রং,রাসায়নিকে দুর্গন্ধময় । নিরঞ্জনের সাথে যেনো বিদায় নিচ্ছে নদীর যৌবনও। ভালো থাকবেন নিরঞ্জন স্যার। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুক আপনার পরিবার।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অন্যতম কারণ জমিদখল। যা দেখেছি, যতটুকু মনে পড়ে মাস্টারের নিজের হাতে গড়া ওই সম্পদ দেখেই কিছু মানুষের পিত্তি জ্বলে যেতো। আর তারাই নানা কাহিনী বলে বেড়াতেন। রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলে এক হয়ে সব কিছু করতে পারেন তারা। এরা হচ্ছেন মালাউন। অভিশপ্ত মানুষ। আপনার আমার আশপাশেই তাদের বিচরণ। এদের ধ্বংস হোক।

NewsDetails_03

? লেখক- শেখ জায়েদ
প্রতিবেদক ও সংবাদ পাঠক, নিউজ ২৪।

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। পাহাড়বার্তার -এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য পাহাড়বার্তা কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

আরও পড়ুন