লামার সবুজ পাহাড়ে কফি চাষের সম্ভাবনা

NewsDetails_01

বাংলাদেশে কফি চাষ শুনলে একসময় থমকে যেতে হত। চায়ের চেয়ে কফি জনপ্রিয় হলেও উচ্চ মূল্যের কারনে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি কফি। চা খাইনি এমন মানুষ না থাকলেও কফি খাইনি এখনও এমন মানুষ দেশে রয়েছে। অথচ সেই কফি এখন বান্দরবানের লামা উপজেলার সবুজ পাহাড়ে সম্ভাবনার ফসল হয়ে উঠেছে। সরকারী বেসরকারী সহযোগিতা পেলে অচিরেই হয়তো দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশের কফি উড়াল দেবে বিশ্বের নানা দেশে। অদুর ভবিষ্যতে উপজেলায় কৃষি শিল্পে বিপ্লব ঘটাবে উচ্চ মূল্যের পানীয় এ কফি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধিনে কফি গবেষণা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন করার কারনে এখন কফি চাষে দিনদিন কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে। প্রথম প্রথম সখ করে দু একজন কফি চারা রোপন করলেও এখন উপজেলার প্রায় বাগাানের মালিকরা বাণিজ্যিকভাবে রোপন করছে কফি চারা। এ পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিমালিকানায় প্রায় ৬৫ একর জায়গা জুঁড়ে ২৯৭৭৫টি কফি গাছ লাগানো হয়েছে বলে জানা গেছে। উচ্চ মূল্যের কফিচাষ সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে বাগানিকে।

কৃষি অফিসের তথ্যমতে, লামায় প্রত্যেক ইউনিয়নের পাহাড়ে কিংবা পাহাড়ের ঢালে লাগানো হচ্ছে কফি চারা। এ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ও ব্যক্তি মালিকানায় প্রায় ৬৫ একর জায়গা জুড়ে ২৯৭৭৫টি কফি গাছ লাগানো হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে ২০১৮-২১ সাল পর্যন্ত ৭ জন কৃষক, ২০২১ সালে বাণিজ্যিকভাবে ৬৬জন কৃষক কফি চারা রোপন করেছেন। হর্টিকালচার ও ডিএই এর মাধ্যমে ৬৬জন কৃষককে চারা, সার, নেট ও নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২.৫ একর করে ৫টি বাণিজ্যিক ও ৫০ শতক করে ৫০টি কফিজাত প্রযুক্তি প্রদশনী দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের দু একটি কফি বাগান ঘুরে দেখা যায়, কোথাও সারিবদ্ধভাবে, কোথাও গাছের ফাঁকে ফাঁকে আবার কোথাও পাহাড়ের উঁচুনিচু ঢালুতে কফি চারা রোপন করেছে বাগানিরা। কোথাও কফি গাছ ৩ থেকে ৪ফুট লম্বা আবার কোথাও বয়স এক সপ্তাহ হতে এক মাস হয়েছে। কোন কোন গাছে ফল আসতেও দেখা যায়। তবে তা পরিপক্ব হয়নি এখনও। কোন কোন বাগানি ইতিমধ্যে কফি উৎপাদন করে এখন বাজারজাতও করছেন।

উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের ব্রীকফিল্ড এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (প্রাথমিক) প্রমোদ চন্দ্র বড়ুয়ার বাগান ঘুরে দেখা যায়, তার সৃজিত ফলজ বাগানের ভিতর ২ একর জায়গায় ১২২৫টি কফি চারা লাগিয়েছেন। এক সপ্তাহ আগে এ চারা রোপন করেন তিনি। পাশের আখিরাম পাড়ায় আরেকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, ৪ থেকে ৫ ফুট লম্বা হয়েছে কফি গাছ। প্রায় গাছে ফলও এসেছে।

NewsDetails_03

নতুন উদ্যোক্তা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বাথোয়াইচিং মার্মা প্রথমে আম বাগান সৃজন করলে তা দেখে এলাকার অনেকে আম বাগান করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তেমনি কফি চাষের উজ্জল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে কফি চাষে কৃষকদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করতে ৪ হাজার কফি চারা লাগান তিনি।

এ্যাসোসিয়েশন অব ড্যাবটিস্টের কফি এক্সপার্ট প্রশিক্ষক তৈদরাম ত্রিপুরা বলেন, একটি কফি চারার মূল্য ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এরা ৭০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়।এরপর ঢালপালা ছেটে মাতৃ গাছের একফুট উপর থেকে তির্ডকভাবে কেটে দিলে পুণরায় ফলন পাওয়া যায়। ১টি গাছ প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ কেজি ফলন দেয়। এর বাজার মূল্য প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা। কফি চাষীদের জন্য সুখবর হচ্ছে দেশীয় ও বিশ্ববাজারে কফির মূল্য একই থাকে। ফলে এর কোন সিন্ডিকেট থাকেনা। দেশে একমাত্র কফি বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নর্দান এন্ড কফি রোষ্টার কোম্পানী।

লামা উজেলার প্রথম উদ্যোক্তা তৈদুরাম প্রথমে ৩ একর জায়গায় সাড়ে তিন হাজার, পরে আরো ১২ হাজার কফি চারা লাগান। ৩ বছরের মাথায় কিছু কিছু গাছে ফলনও আসে। আবাদি অনাবাদি জমি; দুটোতেই কফি চাষ করা যায়। কফি ছায়া সহনীয় গাছ বিধায় চাষীদের জন্য সুবিধা হচ্ছে কফি বাগানের ভিতর অন্যান্য বাগান কিংবা অন্যান্য বাগানের ভিতর কফি বাগান করা যায়। ফলে অন্যান্য চাষের চেয়ে কফি চাষে কৃষকের লাভের সম্ভাবনা বেশি বলে জানান তৈদুরাম।

কৃষি বিভাগের অভিমত চা গুল্মজাতীয় গাছ, কিন্তু কফি একদম গাছ গোত্রেরই। কফি গাছ ছায়া সহ্য করতে পারে। তাই বড় গাছ কিংবা ফলজ গাছের ছায়তলে বেড়ে উঠতে কফি গাছের কোন সমস্যা হয় না। সাধারণত পতিত জমিতে কফি চাষ বাড়ানো গেলে অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে লাভ বেশি। পানি নিষ্কাশনযুক্ত যেকোন উঁচু জমিতে কফি চাষ করা সম্ভব। দেশে রোবাস্টা ও অ্যারাবিকা— দুই জাতের কফি চাষ হচ্ছে। তবে উপজেলায় রোবাস্টা জাতের কফির চাষ বেশি।

এ বিষয়ে লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন চন্দ্র বর্মন বলেন, গত দুই অর্থ বছরে বাগানিদের ১১৫৬৫টি চারাসহ সার, নেট, নগদ অর্থ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের অনাবাদি ও আবাদি জমি কফি চাষের মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বাগানিরা। সেইসাথে অর্থকরী ফসল হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। বিপ্লব ঘটবে কৃষি শিল্পে।

আরও পড়ুন