সীমান্তে বাড়ছে স্থল মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা : ১ সপ্তাহে এক বাংলাদেশীসহ ৪ জন নিহত, আহত অর্ধ ডজন

NewsDetails_01

A Soviet TM-46 anti-personnel mine.
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্ত এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। নো-ম্যান্স ল্যান্ডে বাড়ছে মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা। এক সপ্তাহে এক বাংলাদেশী সহ অন্তত চার রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয় এবং গুরুতর আহত হয়েছে অর্ধডজন বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা।
আগষ্ট মাসে মিয়ানমার সেনা চৌকিতে হামলার পর থেকে আরাকান রাজ্যে চলা রোহিঙ্গা নিধন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত এলাকার ৭টি পয়েন্টের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নেয় প্রায় লাখের বেশি রোহিঙ্গা। স্থানীয় সূত্র জানায়, বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চাইলেও মাইন বিস্ফোরণের ভয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হচ্ছেন না রোহিঙ্গারা অনুুপ্রবেশকারীরা। তারা ওপারে পাহাড়ের বিভিন্ন জঙ্গলে লুকিয়ে রয়েছেন।
সীমান্তে জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গা নাগরিকরা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে আর যেন প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের তুমব্রু, বাইশফাড়ি, আশারতলি, চাকঢালা ও সাপমারাঝিরি, লেমুছড়ি সীমান্ত সহ ৭টি পয়েন্টে বসানো হয়েছে স্থল মাইন। হতভাগা রোহিঙ্গা নাগরিকরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে দীর্ঘ পাহাড়ী পথ পাড়ি দিলেও সীমান্তে এসে অসতর্কতা অবস্থায় স্থল মাইনে পা দিয়ে বিস্ফোরণের শিকার হচ্ছে। এতে কারো দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, আবার কারো শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ খোঁয়া যাচ্ছে।
মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার সইতে না পেরে বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই সীমান্তে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটছে। গত এক সপ্তাহে সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে মাইন বিস্ফোণের ঘটনায় অন্তত এক বাংলাদেশী সহ চার রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছে এবং অর্ধ ডজন বাংলাদেশী-রোহিঙ্গা নাগরিক আহত হয়ে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে।
নাইক্ষ্যছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিরা :
গত ৪ সেপ্টেম্বর ৩টার দিকে সীমান্তের ৩১নং পিলার এলাকা রায়বুনিয়া দিয়ে অনুপ্রবেশ কালে সাবেকুন্নাহার (৪৫), ৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দুপুর ১টার দিকে ৩৪নং পিলারের কাছে কায়সার (১০) ও মো. আলম (৭) নামের দুই রোহিঙ্গা শিশু এবং ১০ সেপ্টেম্বর রবিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ৩৭-৩৮নং পিলারের মধ্যস্থানে বাংলাদেশী যুবক মো. হাসান (৩২) গুরুতর আহত হয়। এসময় তার একটি পা উড়ে যায় এবং চোখেও আঘাতপ্রাপ্ত হয় সে। ১১ সেপ্টেম্বর সোমবার আয়েশা আক্তার নামের এক রোহিঙ্গা নারীও আহত হয়। ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে চাকঢালা সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিক আব্দুল কাদের (৪৮) মাইন বিস্ফোরণে ডান চোখে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে মৃত্যুর সাথে লড়ছে।
নাইক্ষ্যছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে নিহত ব্যক্তিরা :
গত ৬ সেপ্টেম্বর বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সীমান্তের সাপমারাঝিরিস্থ ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া মায়ানমারের ছালিদং এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কাছিমের স্ত্রী গোল ছেহের (৬০), ১১ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল ১১টার দিকে ৪৪নং পিলারের কাছেই রোহিঙ্গা কৃষক ছৈয়দ আহমদ (৫৫), রাত ১১টায় ৪৫নং পিলারের কাছে মায়ানমারের ফকিরাবাজার এলাকার বাসিন্দা মোক্তার আহমদ (৪৫) নিহত হয়। এসময় তার দুই পা মাইন বিস্ফেরণে উড়ে যায়। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশী নাগরিক হাকিম উল্লাহ’র দেহ (৪৫) মাইন বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের বদিউর রহমানের পুত্র বলে জানা যায়।
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আশারতলি চাকঢালা সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশী ৩ জন নিহত ও আহত হয়েছে প্রায় অর্ধডজন। সীমান্তে একের পর এক মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় রোহিঙ্গা ও সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশী নাগরিকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়িস্থ ৩১ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্ণেল আনোয়ারুল আজিম জানান, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্তে কাটাতারের বেড়ার কাছে মাইন পুতে রেখেছে। নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মাইন বিস্ফোরণে হতাহত হওয়ার কথা তিনি শুনেছেন।
গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা :
এদিকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে-গঞ্জে। সরজমিনে উপজেলার বাইশারীতে গিয়ে দেখা যায়, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের গণনা চলছে। কথা হয় গণনাকারী নুরুল কবির রাশেদের সাথে। তিনি বলেন, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়া রোহিঙ্গারা একটু বিশ্রামের আশায় নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীর বিভিন্ন জায়গায় আত্বীয়-স্বজনদের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছে। ইতিমধ্যে তিন ওয়ার্ড মিলে দেড়’শ জনের তালিকা সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া বাইশারীতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে এক সত্তোর্ধ বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে মারা যান বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মো. আলম জানান, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অনুপ্রবেশ করা এসব রোহিঙ্গাদের মানবিক দিক বিবেচনা করে আত্বীয়-স্বজনের বাড়ীতে বসবাস করতে দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদের ইতিমধ্যে তালিকাভূক্ত করার কাজ ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যম শুরু হয়েছে। তবে বর্তমানে কতজন রোহিঙ্গা বাইশারীতে আশ্রয় নিয়েছে এ ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি গনণা করার পরই বলতে পারবেন বলে জানান।

আরও পড়ুন