সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ড্রাইভারদের নিয়ে কাজ করতে হবে

NewsDetails_01

গণপরিবহনের ড্রাইভারদের নিয়ে কি কোন উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন কাজ করছে? যদিও সমাজের একটি বিরাট অংশ আমাদের এই যানবাহনের চালক, যাদের আমরা ‘ড্রাইভার’ নামে সম্বোধন করে থাকি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করার সুবাদে নানা জেলায় কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে কিন্তু কোন সংগঠনকে এই ড্রাইভারদের নিয়ে কাজ করতে দেখা যায় না। তাদের জন্য কোন প্রকল্প সরকারি সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত হচ্ছে বলেও জানা যায় না (সরাসরি ড্রাইভারদের সুবিধাভোগী হিসেবে বাস্তবায়িত কোন প্রকল্পের কথা বলছি)। সমাজে নানা বাস্তবতার কারণে যেমনি একজন শিশু চালকের আসনে বসেন তেমনি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত কিংবা যাদের পড়ালেখা কম তারাই মূলত ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।
ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরের গণপরিবহনের ড্রাইভার বললে, আমাদের সামনে এক ধরনের চিত্র উপস্থাপিত হয় যেমন ময়লা কাপড় চোপড়, মুখে সব সময় গালিগালাজ, বিড়ি সিগারেট টানবে আর ব্যবহার একটু খারাপ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাজে এমন ধরনের পরিচিতি থাকায় মালিকগণের সাথে ড্রাইভারদের একটি নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলাফেরা করতে দেখা যায়। কোথাও বেড়াতে গেলে ড্রাইভারদের সাথে একই টেবিলে বসে খাওয়ার উদাহরণ খুব কম। এই দূরত্ব সরকারি চাকুরিজীবিদের মধ্যে আরো বেশি প্রকট।
ড্রাইভাররাও নিজেদেরকে বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণী হিসেবে দেখে। ফলে এমন ধরনের বঞ্চণা ও বৈষম্য অনুভূতি নিয়ে নিজ থেকে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে কাজ করবে ভাবা যায় না। অধিকাংশ প্রাইভেট ও শহর অঞ্চলের নানা পরিবহনের ড্রাইভারদের জিজ্ঞেস করলে দেখা যাবে, তারা বেতন নিয়ে মোটেই খুশি নয়। মালিক পক্ষকে ড্রাইভারদের সব সময় খুশি রাখতে হয়। কিন্তু মালিকদেরও যে দায়িত্ব থাকতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয় না। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গণপরিবহনে ভাল কর্মী যেমনি খুব কম দেখতে পাই তেমনি শিক্ষিত লোকজন এই পেশায় আসতে আগ্রহী হন না।
এখন সময় এসেছে এই ড্রাইভার সমাজকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নিয়োজিত করার। আমরা যদি এই ড্রাইভার সমাজকে বুঝতে ব্যর্থ হই তবে পরিবহন ব্যবস্থায় শৃংখলা আনয়ন সম্ভব হবে না। তাদের শৃংখলা আনয়নে ব্যর্থ হওয়া মানে, আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে না।
ড্রাইভারদের শিক্ষিত করা গেলে রাস্তাঘাটে নিত্যদিনের যে দুর্ঘটনা হয় তা অনেকাংশে কমে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষিত বলতে আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলছি না। তাদের ট্রাফিক নিয়ম কানুন সম্পর্কে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ভালবাসা, সহযোগিতা, নৈতিকতা আর পরিবেশ বিষয়ে জ্ঞান দেয়া প্রয়োজন। যে পরিবেশ ও সামাজিক বাস্তবতার মধ্যদিয়ে যারা ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে তাদের এই মানবিক মূল্যবোধগুলো অর্জন বা ধারণা লাভের সম্ভাবনা কম থাকে। তাদের যদি এই মানবিক মূল্যবোধগুলো অর্জনে সহায়তা করতে পারি, তাদের মাঝে সচেতনতাবোধ জাগ্রত হওয়ার মাধ্যমে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নিজ থেকে আত্মনিয়োগ করবে।
আমাদের দেশে ড্রাইভিং লাইন্সেস পেতে শুধু ট্রাফিক সিগ্নাল আর গাড়ি চালনার দক্ষতাকে দেখা হয়। ফলে তাদের মাঝে অন্যান্য গুণাবলী না থাকলেও ড্রাইভার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। একজন ড্রাইভার হয়ে শুধু পয়সা উর্পাজনকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নিয়ে থাকে। তার দ্বারা সৃষ্ট যানজট,শব্দ দূষণ, যাত্রীদের ভোগান্তি সবই মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
শহর অঞ্চলের যানজট সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ হলো যেখানে সেখানে যাত্রী উঠা নামা করানো। শহর এলাকার যাত্রীবাহী বাসসহ অন্যান্য গণযানবাহনের চেহারা অত্যন্ত নাজুক হয়ে থাকে। প্রায় সব কটি গাড়িতে দেখা যাবে হেড লাইট, সাইট লাইট ঠিকমত কাজ করে না কিংবা গাড়ির ভিতরে থাকা ফ্যান চলে না। শহর এলাকায় চলাচল করা কোন যাত্রীবাহী বাসকে নিয়মিত পরিস্কার রেখে যাত্রীসেবা দানের চেষ্টা করতে দেখা যায় না।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনসমূহকেও পরিবহন কর্মীদের নিয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসা উচিত। পরিবহন কর্মীদের নিয়ে কাজ করতে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকবে। কিন্তু আমরা যদি সঠিন পরিকল্পনা আর ড্রাইভার সংগঠনসমূহের সাথে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারি, অনেকাংশে সহজ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রয়োজনে আকর্ষণীয় দৈনিক ভাতার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এবং প্রশিক্ষণ সময়ে অবশ্যই ডকুমেন্টারি ফ্লিম প্রর্দশন করতে হবে যাতে সহজে বুঝতে পারে, তাঁদের একটু অবহেলা সমাজে কোথায় কোথায় প্রভাব ফেলে। একটি দূর্ঘটনা তার পরবর্তী মানুষের, পরিবারের দূর্ভোগ চিত্রগুলো উপস্থাপন করতে হবে যাতে ড্রাইভারদের মনে সারা জীবনের জন্য দাগ কাটে।
এইজন্য চালক, সমিতির পাশাপাশি মালিকদেরকেও প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতায় নিয়ে আসা দরকার। অনেক সময় মালিকগণ ড্রাইভারদেরকে অত্যধিক কাজে বাধ্য করতে শুনা যায় যেমন ঢাকা শহরে সিএনজি ড্রাইভারটি যদি একদিন চালাতে না চান তাতে মালিক রাজি হন না। মালিকগণ একদিনও তার সিএনজিকে বসিয়ে রাখতে চান না। বাধ্য হয়ে ড্রাইভারগণ প্রতিদিন গাড়ি চালান। যদি না চালান তবে সিএনজিটি তার হাত ছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনুরুপভাবে ভাড়ায় চালিত নানা যানবাহনের ড্রাইভারকে (কোথাও দূরে ভাড়া নিয়ে গেলে) বিশ্রাম ব্যতিরেকে ফিরতে বাধ্য করানো হয় বলে শুনা যায়। এই মালিকগণের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি।
ড্রাইভারদের নানা রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করতে দেখা যায় কিন্তু তাদের গঠনমূলক উন্নয়নের জন্য খুব কম সংগঠন আজ পর্যন্ত কাজ হতে নিয়েছে।
দেশে হাজার হাজার বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের এই বিরামহীন সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে কাজ করা আশু প্রয়োজন। তবে প্রকল্প প্রণয়নে সংগঠনসমূহকে যথেষ্ট সর্তক হতে হবে কেননা এই ড্রাইভার সমাজ নানাভাবে বিভক্ত। শহর অঞ্চলের গণ পরিবহনের যেমন একটি সমাজ বা পরিচিতি আছে তেমনি ট্রাক ড্রাইভারদেরও আলাদা একটি সংস্কৃতি রয়েছে। প্রায় প্রতিটি হাইওয়েগুলোতে ট্রাক ড্রাইভারদের জন্য আলাদা ছোট বড় খাবারের দোকানের পাশাপাশি বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকে যে দোকানগুলোকে অন্যান্য যাত্রীবাহী বাস ড্রাইভারগণ খুব কমই ব্যবহার করে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকেও এনজিওদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত। কেননা প্রকল্পটি যদি শুধু প্রশিক্ষণ নির্ভর হয় এতে অনুমোদন লাভে এনজিওটিকে যথেষ্ট বেগ পেতে হতে পারে। বলা হয়ে থাকে শুধু প্রশিক্ষণ দিয়ে কি হবে ইত্যাদি। তবে এইটুকু বুঝতে হবে অবকাঠামো উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নিমার্ণ, বস্তুগত সম্পত্তি প্রদান শুধু উন্নয়ন নয়। মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তন, চিরাচরিত কিছু অভ্যাস, বিশ্বাস পরিবর্তনেও প্রশিক্ষণ দরকার।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিত ‘নিরাপদ’ স্মরণিকার তথ্য মতে গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭২৬ আর আহত হয়েছেন আরে ২২ হাজার ১৯২ জন (প্রথম আলো, ২৯ জানুয়ারী ১৭)। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি জেলায় আলুটিলা পাহাড়ে হেলপার দ্বারা পাথর বোঝায় ট্রাকটি চালাতে গিয়ে ৮ জনের প্রাণসহ ১০জনকে আহত করে। এমন ধরনের তথ্যই বলে দেয় কেন এই ড্রাইভারদের নিয়ে কাজ করা জরুরি। এই বিষয়ে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনসমূহকেও বাস্তবসম্মত প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক: উন্নয়নকর্মী,খাগড়াছড়ি।
ইমেইল: [email protected]

NewsDetails_03

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। পাহাড়বার্তার -এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য পাহাড়বার্তা কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

আরও পড়ুন