শাস্তি পেয়ে বান্দরবানে এসে করছেন বদলি বাণিজ্য !
পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালক
‘ওভারনাইট বান্দরবানে পাঠিয়ে দেব’-আমাদের দেশের একটি বিজ্ঞাপন চিত্রের সংলাপ। দুর্গম কোনও এলাকায় বদলিকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবেই দেখা হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসৎ কর্মকর্তা দের পাহাড়ে শাস্তিমূলক বদলি যেন থেমে নেই। আর এই অসৎ কর্মকর্তাদের কারনে স্থানীয়দের দূর্ভোগেরও অন্ত নেই। নারী কেলেঙ্কারি ও অর্থ আত্মসাতের কারনে বান্দরবানে বদলি করা হয়েছিল বান্দরবান জেলা পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালক মো: রফিকুল ইসলামকে। কিন্ত বান্দরবানে এসে তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৫ সালের ১৭ মে জেলা পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতির পর আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে করছেন বদলি বাণিজ্য। মেতেছেন বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা নারী সহকর্মীদের হয়রানি, এছাড়াও বিনা ভাড়াতে থাকছেন মাতৃমঙ্গলের গেস্ট হাউজে। সহকারী পরিচালক হয়ে দায়িত্ব নেয়ার পর ও থানচি উপজেলার পাশাপাশি রুমা উপজেলারও দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন। এমনটাই অভিযোগ উঠেছে বান্দরবানের বর্তমান জেলা পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালক মো: রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে নেত্রকোণা সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় নারী কর্মীদের নানাভাবে উত্যক্ত ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের তদন্তে সত্যতার প্রমান পেলে শাস্তিমূলক ভাবে জেলার থানচি উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে বদলি করা হয়। থানচিতে যোগ দিয়ে বেশির ভাগ সময় অফিস না করেই বেতন নিতেন তিনি। চলতি বছরের ১৭ মে তিনি পদোন্নতি নিয়ে বান্দরবান পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়ে আগের চেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
আরো জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিনা ভাড়াতে মাতৃমঙ্গলের গেস্ট হাউজে রাত কাটান। অফিস সময় শেষ হলেও রাত জেগে মাতৃমঙ্গলে নারী কর্মীদের সামনে বসিয়ে গল্প করেন। তার ক্ষমতার ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারে না। বেশ রাত অবধি নারী কর্মীদের উত্ত্যক্ত করা ও তাদের অন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাজে বিলম্ব করানোর অভিযোগ করেন প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে। আর এসব কিছু যেন প্রকাশ না পায় সেজন্য অফিসের একমাত্র সিসি ক্যামেরা ঠিক থাকার পরও ক্যামরা নিয়মিত বন্ধ রাখা হয় বলে জানান ভুক্তভোগিরা।
রাতের আঁধারে বদলি বাণিজ্যে আর্থিক লেনদেন করার মাধ্যমে পছন্দের কর্মীকে ভাল জায়গায় এবং অপছন্দের কর্মীকে পাঠানো হয় দুর্গম এলাকায়। তার ডাকে সাড়া না দিলে দূর্গম এলাকায় বদলিরও হুমকি দেয়া হয় তাদের। গত ৭ আগষ্ট ৬ জন নারী কর্মীসহ এক মাসেই বদলি করিয়েছেন প্রায় ডজন খানেক। যারা লেনদেন করেছেন তারা ভাল স্থানে, যারা অস্বচ্ছল এবং খুশিমত লেনদেন করতে পারেনি তারা পড়েছেন দূর্গমে। সম্প্রতি রাতের আঁধারে অফিসে বসে তিনি ফের করছেন বদলির নতুন তালিকা।
এদিকে রাতের বেলায় তিনি মাতৃমঙ্গলের গেস্ট হাউজে থাকার কারণে সেখানেও চলছে নানান গুঞ্জন। মাঠ পর্যায়ের বদলি হওয়া ও বদলির হুমকি পাওয়া কয়েকজন কর্মী জানান, জেলা অফিসের স্টাফদের সহযোগিতা নিয়ে বদলি বাণিজ্যে মেতেছেন তিনি। লেনদেনের টাকার ভাগও পায় জেলা অফিসের স্টাফরা। আর তাই সহজে মুখ খুলতে চায়না তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মী জানায়, জেলা পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালকের আচরণ নারীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন, তার দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন। মান-সন্মানের ভয় আর নিরাপত্তাজনিত কারনে সরকারী প্রতিষ্ঠানটির নারী কর্মীরা এসব বিষয় নিয়ে কোথাও অভিযোগ দেওয়া ও প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। এমন অবস্থায় তদন্তের দাবি জানিয়ে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানান তারা।

তারা বলেন, যদি তদন্ত হয় এবং আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবে অবশ্যই তদন্ত টিমের কাছে তার (মো: রফিকুল ইসলাম) নোংরামির কথা জানাবো। তার সহধর্মীনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার কারণেই হয়তো অন্য নারীদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এছাড়া সহধর্মীনির চিকিৎসার জন্যও প্রয়োজন হয় বাড়তি টাকার। আর এসব কারণেই তিনি নারী এবং টাকা দুটোর প্রতিই আসক্ত হয়ে পড়েছেন। স্ত্রীর ক্যান্সারের চিকিৎসার নামে উপজেলা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা ছাড়াও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছেও স্ত্রীর চিকিৎসার নামে তিনি অর্থ চেয়েছেন। এসব বিষয় তদন্তের দাবি তুলেছেন অনেকে।
এই বিষয়ে বান্দরবান জেলা পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালক মো: রফিকুল ইসলাম এর কাছে রাতে একা অফিস করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি সম্পন্ন করতে রাতে অফিস করতে বাধ্য হয়েছেন। এদিকে রাতে তিনি মাতৃমঙ্গলের গেস্ট হাউজেই থাকেন স্বীকার করে দ্রুত সরে পড়েন।
মাতৃমঙ্গলের গেস্ট হাউজে থাকার বিষয়ে জানতে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার ডা: কামরুল মনি রিবনকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
জেলা পরিবার পরিকল্পনার উপ পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা: লেনিন তালুকদার বলেন, বিকাল ৫ টার পর অফিস সময় শেষ হলেও হয়তো একটি তদন্ত চলছে যার কারণে জেলা পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালক রাতে অফিস করছেন, বিষয়গুলো আমি দেখবো।
জেলা পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালককে শাস্তিমূলক বান্দরবানে বদলির বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক আবু সালেহ মো: ফোরকান উদ্দিন বলেন, মানুষ যত অপরাধই করুক, তাকে সংশোধন হবার সুযোগ দিতে হয়। জেলা পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পরিচালক যদি আবারো আগের মত করে তবে আপনারা সত্য বিষয় লিখুন। বিভাগটি পার্বত্য জেলা পরিষদে ন্যস্ত, তাই ব্যবস্থা নেয়া পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব।
এই বিষয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক থানজামা লুসাই এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আর বদলী বাণিজ্য করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে পরিষদ চীফকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি।
এদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দূর্নীতিবাজ আর অসৎ কর্মকর্তাদের বান্দরবানসহ অপর দুই পার্বত্য জেলায় বদলি করার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে পার্বত্য জেলার সাধারন মানুষ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমিতিসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলো।