অবশেষে অন্ধ লক্ষীরাণী পেলো লক্ষীনিবাস
সত্তরোর্ধ্ব স্বামী সন্তান হারা অন্ধ লক্ষী রানী দে। রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতাল এর বারান্দায় গত ১৫ বছর ধরে তিনি বসবাস করে আসছেন। হাসপাতালের বারান্দা ছাড়াও মিশন হাসপাতাল গেইট এবং চন্দ্রঘোনা দোভাষী বাজারে দিনরাত কাটে তার। কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা কিংবা উৎসব পার্বন কখন যে চলে যায় তার জীবনে এই সবের কোন কিছু আসে যায় না। প্রতিদিন একবেলা আহার পেলেই চলে যায় তার দিবারাত্রি। জীবনের সুখের বসন্ত কি, লক্ষী রানী দে’ র গত ৩০ বছরেও একবার আসেনি।
রাঙামাটির রাজবাড়ি এলাকায় তার বাবার বাড়ী। তার বাবার নাম ক্ষিতিশ বিশ্বাস। কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার ফলে তাদের পৈত্রিক বাড়ী কাপ্তাই লেকে তলিয়ে যাবার পর স্বাধীনতার আগে তারা স্ব-পরিবারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা হিন্দু পাড়ায় মামার বাড়ীতে চলে আসেন। সেখান থেকে তার বিয়ে হয় রাউজান উপজেলার উনসত্তর পাড়া গ্রামের মানিক চন্দ্র দে’এর সাথে। সুখেই চলছিল তাদের জীবন। স্বামী কৃষি কাজ করে সংসার চালাতো। এরই মধ্যে তার ২ সন্তান পৃথিবীতে ভুমিষ্ট হয়। কিন্ত সবার কপালে কি সুখ আর সয়। তার প্রথম সন্তান লিটু দে মাত্র ১৩ বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যধিতে মারা যান পাহাড়তলি শ্বশুর বাড়ীতে। তার বড় ছেলে লিটু মারা যাবার পর ৬ বছর পর আর এক ছেলে সুজয় দে মাত্র ১১ বছর বয়সে সেখানে মারা যান। ছেলে হারা লক্ষী রানীর জীবন যেন এক বিভীষিকায় পরিনত হয়।
কথাই আছে “মরার উপর খাড়ার ঘাঁ”। ছেলে হারানোর ৮ বছর পর পুত্রশোক সইতে না পেরে লক্ষী রানী দে’এর স্বামী মানিক চন্দ্র দে সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। স্বামী মারা যাবার পর তার জীবনে নেমে এসে আরোও চরম দূর্বিসহময় দিন। শশুড় বাড়ীর লোকজনের অত্যাচারে তিনি এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে চন্দ্রঘোনা হিন্দুপাড়া মায়ের ঘরে চলে আসেন। সেখানেও তার সুখ পাখি যেনো অধরা হয়ে রইল। সহায় সম্বল যা ছিল তা নিয়ে তার এক ভাই চলে যান অন্যত্র।
এরপর তিনি চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতাল এর চিকিৎসক ডা: মনোজ বড়ুয়ার বাসায় কাজ নেন। ডা: মনোজ বড়ুয়া ছাড়াও মিশন এলাকার অনেকের বাসাবাড়ীতে ঝি এর কাজ করে কোন রকমে তার জীবন চলতো।
এরই মধ্যে তার জীবনে আসে আরো একটি দু:স্বপ্ন। ১৯৯২ সালে চোখে দেখা দেয় তার কঠিন রোগ। অপারেশন করতে গিয়ে তিনি হারান তার দু’চোখ। চোখ হারানোর পর অনেকের বাসায় তার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন মানুষের দেওয়া অন্ন বস্ত্রে তার জীবন চলে। যেদিন পায় সেদিন খায়, না পেলে কখনোও কখনোও পানি খেয়ে হাসপাতাল এর বারান্দায় ঘুমিয়ে যান লক্ষী রানী দে।
বিভিন্ন সময় পত্র পত্রিকায় লক্ষ্মী রানী দে’ কে নিয়ে বিভিন্ন হ্রদয়বিদারক সংবাদ প্রচারিত হয়। এই সব সংবাদ নজরে আসার পর এগিয়ে আসেন কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনতাসির জাহান। তিনি বেশ কয়েকবার মিশন হাসপাতাল গেইট এলাকায় এসে লক্ষী রানীর খোঁজ খবর নেন এবং তাঁকে আর্থিক সহায়তা করেন। সেইসময় ইউএনও মুনতাসির জাহান তাঁকে ঘর করে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। ইউএনও এর এই উদ্যোগে এগিয়ে চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা মংচিং মারমা। তিনি এক গন্ডা জায়গা দেন লক্ষী রানী দে কে ঘর করে দেবার জন্য। সেই জায়গার উপর কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান স্থানীয় উদ্যোগে গত মাসে ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন।তিনি কথা দিয়েছিলেন ভরাবর্ষার আগেই লক্ষী ঘরে উঠবে। কথা রেখেছেনও তিনি।
অবশেষে বুধবার (১ জুন) বেলা ১২ টায় কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান ঐ জায়গায় এসে অন্ধ লক্ষী রানী দে’ কে নিজে এসে নতুন ঘরে তুলে দেন।লক্ষীর জন্য নতুন কাপড়, খাবারদাবার,ঘরের সরঞ্জামাদিসহ নিয়ে আসেন তিনি।
এসময় উপস্থিত সকলকে মিস্টিমুখ করিয়ে লক্ষীনিবাসের যাত্রা শুরু করা হয়। এইসময় কাপ্তাই উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রুহুল আমিন, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নাজমুল হাসান, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ বি কে দেওয়ানজী, চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা সজল বিশ্বাস, কাপ্তাই প্রেস ক্লাব সাধারণ সম্পাদক ঝুলন দত্ত সহ স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।