লামায় পাহাড় কেটে সাবাড়

NewsDetails_01

পৃথিবীর লৌহদন্ড বলা হয় পাহাড়কে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় যার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এর ওপর ভর করেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অথচ একশ্রেণির ভূমিদস্যু নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সেই পাহাড়গুলোকে একের পর এক সাবাড় করে দিচ্ছে। এমনিই একটি ঘটনা ঘটেছে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা-ঈদগড় সড়কের রাজাপাড়া সংলগ্ন সড়কের পূর্বপাশে।

পাহাড়ের উপর সৃজিত কয়েক হাজার কলাগাছ নিধন করে পাহাড় কেটে সাবাড়ের ঘটনাটি ঘটিয়েছেন অর্পন মহাজন নামের এক ব্যক্তি। এর আগেও তিনি পাশের আরেকটি পাহাড় কেটে সাবাড় করেছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী পাহাড় কাটা অবৈধ হলেও এর তোয়াক্কা করছেন না এই ব্যক্তি।

জানা যায়, লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বনপুর এলাকায় জনৈক ইমারত হোসেন নামের অবসরপ্রাপ্ত এক সেনাবাহিনী সদস্যের প্রায় ৭২ কানি জায়গা জুড়ে পাহাড় রয়েছে। এ পাহাড় লীজ নেন স্থানীয় বনপুর বাজার এলাকার বাসিন্দা মৃত রাজেন্দ্র লালের ছেলে অর্পন মহাজন। পরবর্তীতে তিনি এর মধ্যে কিছু জায়গা ৭ হাজার টাকায় স্থানীয় জয়নাল আবেদীন ও ৩০ হাজার টাকায় বেবী রানী দে’র কাছে ৪ বছরের জন্য লাগিত দেন। লাগিয়ত নেওয়ার পর জয়নাল আবেদীন ও বেবী রানী দে ওই পাহাড়ি জাযগায় বহু কায়িক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়ে কলা বাগান সৃজন করেন। বাগানে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি কলা চারা রোপন করেন লাগিয়তপ্রাপ্তরা। কিন্তু বছর যেতে, না যেতেই অর্পন মহাজান ক্ষমতার দাফট দেখিয়ে এক্সকেভেটর লাগিয়ে ওই পাহাড় কেটে সাবাড় করে দেয়। এতে লাগিয়ত প্রাপ্তদের প্রায় দুই লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়। গত ৮-১০ দিন ধরে দিনে-রাতে সমানতালে একের পর এক পাহাড় কেটে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে তৈরি করেছেন সমতল ভূমি। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটা অব্যাহত রাখলেও, এ যেন দেখার কেউ নেই।

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, সড়কের পূর্বপাশে রাজাপাড়া সংলগ্ন স্থানে এক্সকেভেটর লাগিয়ে সুউচ্চ পাহাড় কেটে পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঝিরি ভরাট করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়. সেখানে দেখা গেল ফলন্ত কলা বাগান নিধনের কর্মযজ্ঞও। প্রায় দুই একর উঁচু-নিচু সবুজ অরণ্য ঘেরা পাহাড় কেটে ঝিরি ভরাট করে সমতল ভুমি তৈরি করেছে অর্পন মহাজন।

এ সময় ভুক্তভোগী বেবী রানী দে বলেন, আমি গরীব ও অসহায়। ভিটেমাটি পর্যন্ত নাই। অন্যের ঘরে থাকি। এর মধ্যে নিজের জীবন জীবিকার জন্য একটি বেসরকারী এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কলা বাগান করার জন্য অর্পন মহাজন থেকে পাহাড়ি জায়গা লাগিয়ত নিয়েছিলাম। কথা ছিল ২০২২ সাল থেকে আগামী চার বছর পর্যন্ত লাগিয়তপ্রাপ্ত জায়গা ভোগ করবো। সে মতে আমি ওই জায়গায় আরও কিছু ঋণ নিয়ে প্রায় এক হাজারেরও বেশি কলা চারা রোপন করি। এতে প্রায় আরও লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। এখন ফলন আসার সময়। কিন্তু এর মধ্যে অর্পন মহাজন কোন ধরণের কথা বার্তা ছাড়া আমার রোপিত ফলন্ত কলাগাছগুলো এক্সকেভেটর লাগিয়ে নিধন করে পাহাড় কেটে সাবাড় করে দিয়েছে। এখন আমি ঋণের টাকাগুলো কিভাবে শোধ করবো। আমার এখন মরণ ছাড়া আর কোন উপায় থাকলো না। আমি আমার ক্ষতিপূরণ চাই। একই কথা জানালেন আরেক ক্ষতিগ্রস্ত জয়নাল আবেদীনও।

NewsDetails_03

তিনি বলেন, আমি ক্ষতিপূরণ চেয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান বরাবরে অর্পন মহাজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কারণে এখন তার ছেলে আমাকে মারার জন্য হুমকি দিচ্ছেন। এ বিষয়ে অভিযুক্ত অর্পন মহাজনের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েক বার রিং দিয়ে কোন সংযোগ না পাওয়ায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকলেও প্রশাসন কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে জানান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন স্থানীয় অধিবাসী। তারা এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এ বিষয়ে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মমিগ্য মার্মা জানান, অর্পন মহাজন কর্তৃক লাগিয়রপ্রাপ্তদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে জোর পূর্বক কলাগাছ ও পাহাড় নিধনের ঘটনাটি খুবই দু:খ জনক। এটা মেনে নেওয়া যায় না।

পরিবেশবাদী এম রুহুল আমিন জানায়, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬(খ) অনুযায়ী পরিবেশ সুরক্ষায় পাহাড় কাটা সম্পর্কে বাধানিষেধ রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন ও/বা মোচন করা যাইবে না। অথচ এ আই কেউ মানছে না। অপরিকল্পিত ভাবে পাহাড়কাটার কারণে প্রতি বর্ষা মৌসুমে উপজেলায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। এতে জান মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। প্রশাসনিকভাবে পাহাড়কাটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এমনটি চলছে। অবিলম্বে পাহাড় খেকোদের অপতৎপরতা বন্ধ করা না গেলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

তবে পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান জেলার উপ-পরিচালক ফখর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, লামা উপজেলার বনপুর এলাকায় অর্পন মহাজন কর্তৃক পাহাড় কেটে সাবাড়ের অভিযোগ পেয়েছি। পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংসকারীকে কোন ছাড় নয়। ঘটনাস্থলে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আরও পড়ুন