খাগড়াছড়ির পর্যটন : সুদিন আসবে সরকারি উদ্যোগে

একসময় পার্বত্য তিন জেলার পর্যটন বলতে প্রথমত রাঙামাটি. তারপর বান্দরবান জেলাকেই সমতলের মানুষ চিনতো। পর্যটন শব্দটির সাথে খাগড়াছড়ির সাধারণ মানুষের পরিচিতি কিছুটা দেরিতে ঘটলেও গত এক দশকে তা ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুততার সাথে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথেও জড়িয়ে গেছে দিনখাওয়া অনেক নারী-পুরুষের জীবিকার চক্র। খাগড়াছড়িতে এখন পর্যটন-পর্যটক শব্দযুগল মিশে গেছে আবাসিক-অনাবাসিক হোটেল, পরিবহন খাত, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাক-সবজি, ফলমূল, গবাদিপশু ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সাথে। এই বহুমুখী ব্যবসা সম্প্রসারণের নেপথ্যে সবচেয়ে বড়ো অনুঘটকের কাজ করেছে সমতলের ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা। অর্থনৈতিক বিস্তৃতির দীর্ঘমেয়াদী এই যাত্রার আধার হিশেবে প্রধান ভূমিকা রেখেছে প্রতিবেশী রাঙামাটি জেলার অনন্য পর্যটনস্পট বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক উপত্যাকা। সরকারের সদিচ্ছায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দীর্ঘ শ্রম আর ঘামে দীঘিনালা-বাঘাইহাট-গঙ্গারাম-মাচলঙ হয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটারের এই পাহাড়ি সড়ক যুক্ত করেছে প্রাকৃতিক পর্যটনের সদূরপ্রসারী এক সেতু। যেই সেতুর বদৌলতে প্রতিবছর শত কোটি টাকার ব্যবসা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে। দীঘিনালা টু সাজেক সড়ক নির্মাণ এবং সাজেক ঘিরে একটি নান্দনিক পর্যটন স্পটের স্বপ্নময় উন্নয়নের জন্য ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ পুরো দেশবাসীর পক্ষ থেকে মনখোলা ধন্যবাদ পাচ্ছে প্রতিদিন। আমি ব্যক্তিগতভাবেও মনে করি, এই ধরনের আরো আরো ‘রোড কানেক্টিভিটি’ গড়ে তোলা হলে তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন নবদিগন্তের সূচনা করবে।

গত রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সারাদেশের জন্য চলমান পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন উদ্যোগের অংশ হিশেবে খাগড়াছড়ি জেলার পর্যটন বিকাশে করণীয় শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব মাহাবুব আলী এমপি, সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস মহোদয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব, পর্যটন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়াও খাগড়াছড়ির বিশিষ্টজনরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অংশ নেন।

NewsDetails_03

সভায় স্বাগতিক বক্তব্যে খাগড়াছড়ি জেলার পর্যটন বিকাশে অত্যন্ত চমৎকার ও ফলপ্রসূ আলোচনা তুলে ধরেছেন খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস। পর্যটন বোর্ডের পক্ষ থেকে পাওয়ার প্রেজেন্টশনেও এই জেলার পর্যটন সম্ভাবনার নানাদিক তুলে ধরা হয়েছে। সেই আলোচনায় অন্য অনেকের মতো আমিও একজন শ্রোতা ও দর্শক হিশেবে অংশ নিতে পেরেছি। খুব আশাবাদী হয়েছি, সরকার দীর্ঘ মেয়াদে এই প্রথমবারের মতো তিন পার্বত্য জেলার পর্যটনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের অনুসন্ধান ও গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত এই উদ্যোগে তিন জেলার সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের মতামত প্রতিফলনের মাধ্যমেই সরকার তিন পার্বত্য জেলায় স্থায়িত্বশীল পর্যটন শিল্প বির্নিমাণে আগ্রহের প্রত্যয় প্রকাশ করেছেন সভাটির প্রধান অতিথি প্রতিমন্ত্রী মাহাবুব আলী এমপি।

গত পাঁচ/ছয় বছর ধরে খাগড়াছড়িতে যে কজন জেলা প্রশাসক দায়িত্ব পালন করেছেন; তাঁরা প্রত্যেকেই এ জেলার পর্যটন বিকাশে যথাসাধ্য ভূমিকা রেখেছেন। তবে বেশিরভাগ উদ্যোগ অপরিকল্পিত ও দূরদর্শী না হওয়ায় প্রত্যাশিত সুফল মেলেনি। জেলাশহরের কাছের দর্শকপ্রিয় পর্যটনস্পট ‘আলুটিলা’ ও ‘রিছাং ঝর্না’ এলাকার বিপুল পরিমাণ সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত টিলাভূমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠি দখলে নিলেও প্রশাসন সাহসী কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আমরা আশা করবো, সরকারের গৃহীত মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে জেলার পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকায় বেদখলকৃত সরকারি খাস ও অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল দখলমুক্ত করে পর্যটন এলাকার পরিধি ও পরিসর বাড়ানো হবে। এই ক্ষেত্রে সরকার রাজনৈতিক নেতা-জনপ্রতিনিধি-মিডিয়া ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করতে পারেন। অতি সম্প্রতি খাগড়াছড়ি জেলার বর্তমান জেলা প্রশাসক মানিকছড়িতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রাখা ১’শ ৪০ একর পাহাড়ি টিলাভূমি মুক্ত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছেন। সেক্ষেত্রে যদি সরকারি দলের স্থানীয় নেতারা উদার মানসিকতায় এগিয়ে আসেন তাহলে জেলার পর্যটন বিকাশের পথ দ্রুত প্রশস্ত হবে এবং জেলাবাসীর জীবন জীবিকার গতি বাড়বে।

এবার আসা যাক, পর্যটন বিকাশের গতির সাথে পরিবেশ-প্রকৃতির সম্মতি কেমন হবে; সে প্রসঙ্গে। জনাব মো: রাশেদুল ইসলাম, খাগড়াছড়ির একজন জেলা প্রশাসক থাকাকালে আলুটিলা এলাকার উন্নয়নে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন। কিন্তু প্রবেশপথের বয়সী বটবৃক্ষকে টাইলস বন্দী করে তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন। যেমন খাগড়াছড়ি শহরে অতি উন্নয়নের অজুহাতে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পুকুর-জলাশয় সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনমতের প্রতিফলন ঘটছে না। ফলে শহরটি যেনো বৃক্ষবৈরী হয়ে উঠছে। কোথাও খোলামাঠ-উদ্যান রাখার বালাই নেই। জেলাশহরের খুব নিকটে কৃষি প্রকল্পের পরিত্যক্ত একটি বিশালাকার জায়গা ঘিরে পার্বত্য জেলা পরিষদ একটি পার্ক বির্নিমাণ করলেও সেটি এখন টাকা হাতিয়ে নেয়ার মোক্ষম এক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অবকাঠামোর ভাঙ্গাগড়ার মাধ্যমে সরকারি অর্থ লোপাটের দিকে বেশি মনোযোগী হবার কারণে প্রবেশপথের শ্রীহীন সড়ক প্রতিদিন কর্তৃপক্ষকে যেনো ধিক্কার দিচ্ছে। রিছাং ঝরনার প্রবেশ পথের করুণ দশাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই জেলার উন্নয়ন ভাবনা ও দর্শন, কতোটা একচোখা। অথচ, যেখানে-সেখানে, নিজেদের স্বার্থে, বাড়িভিটা রক্ষায় কোটি কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে; কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় কম বাজেটের উন্নয়ন প্রকল্প বছরের পর বছর অবস্তবায়িত থেকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন