দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে একমাত্র বান্দরবান পার্বত্য জেলায় স্বাধীনতার ৫০ বছরেও গড়ে উঠেনি কোন শিল্প কারখানা। বিসিক শিল্প নগরী গড়ে তোলার জন্য গত ২০ বছর ধরে চিঠি চালাচালি হলেও অধরা থেকে গেছে বান্দরবানবাসীর এই স্বপ্ন। ফলে কর্মসংস্থান না হওয়ায় বাড়ছে বেকারত্ব। আর এই বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন তৈরী করেছেন এস বাসু দাশ।
জানা যায়, বান্দরবান জেলায় প্রতি মৌসুমে আনারস, কলা, কমলা, মাল্টা, পেঁপে, কাজু বাদাম, কলাসহ বিভিন্ন ফলের বাম্পার ফলন হয়ে থাকে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে উল্ল্যেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তাছাড়া রয়েছে আদিবাসীদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র কুটির শিল্প পণ্যের সম্ভার। ব্যাপক সম্ভবনা থাকা স্বত্ত্বেও শিল্প নগরী গড়ে উঠার সম্ভবনা ভেঙ্গে যেতে বসেছে।
আরো জানা যায়, এসব সম্ভবনাকে কাজে লাগতে বান্দরবান শহরের বালাঘাটা এলাকায় ১০ একর জমির উপর ফুড প্রসেসিং কারখানা, ফল সংরক্ষনের জন্য আধুনিক হিমাগার, কুটির শিল্প উন্নয়নে যথাযথ প্রশিক্ষন ও কারখানা স্থাপনে ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হয় ২০০১ সালে। বান্দরবান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন এই সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এই পর্যায়ে এসে থমকে যায় বান্দরবানবাসীর কাঙ্খিত স্বপ্ন।
বান্দরবান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে জেলা শহরের বালাঘাটা এলাকায় বিসিক শিল্প নগরী গড়ে তোলার জন্য ৭২ লক্ষ টাকা চেয়ে তৎসময়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়, জমির দাম বেশি হবার কারন দেখিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি জেলায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এরপর থেকে ফাইলটি লাল ফিতায় বন্দি থাকার পর ২০১৯ সাল থেকে ফের চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
বান্দরবান উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এর সভাপতি লালচানি লুসাই বলেন, বান্দরবানে শিল্প নগরী দ্রুত করা প্রয়োজন, এটা হলে জেলায় বেকারত্ব কমবে।
১৯ সালের ৬ মার্চ শিল্প মন্ত্রীকে প্রেরিত এক পত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি বলেন, বান্দরবানে বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের অপার সম্ভবনা রয়েছে। এখানকার পাহাড়ী মেয়েদের তাঁত শিল্প খুবই বিখ্যাত। এছাড়া বাঁশ, বেত ও কাঠ উৎপাদন হয়। আনারস, কলা, আম, লিঁচু, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফল উৎপাদন হয়। এখানে বিসিক শিল্প নগরী স্থাপন হলে উৎপাদিত পণ্য কাচাঁমাল হিসাবে ব্যবহার হবে এবং অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে।
এখানকার অধিকাংশ জনগন দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। বিসিক শিল্প নগরী স্থাপন হলে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়ে বেকারত্ব দূর হবে। বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের জন্য অধিগ্রহনের জন্য পর্যাপ্ত জমি রয়েছে বলেও শিল্প মন্ত্রীকে অবহিত করেন পার্বত্যমন্ত্রী।
আরো জানা গেছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় ৭৮টি শিল্প নগরী থাকলেও একমাত্র জেলা হিসাবে বান্দরবানে শিল্প নগরী নেই।
বান্দরবান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এর ডাইরেক্টর একে এম জাহাঙ্গীর পাহাড়বার্তা’কে বলেন, বিপুল সম্ভবনা থাকা সত্বেও অনগ্রসরতা ও মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কম, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারনে শিল্প নগরী গড়ে উঠছেনা।
২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর তৎকালিন সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো: নোমান হোসেন স্বাক্ষরিত এক পত্রে দেখা যায়, বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের জন্য ৩১৩ নং বান্দরবান মৌজার হোল্ডিং নং ১৩৭ ও ৫৭৬ এর ৮ একর জমি অধিগ্রহনের তদন্ত করা হয়।
একই বছরের ২৫ নভেম্বর তৎকালিন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়, বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের জন্য ৩০-৫০ একর আয়তনের ৩টি সম্ভব্য স্থান চিহ্নিত করে জমির বিস্তারিত বর্ণনাসহ সাম্ভব্যতা সমীক্ষা প্রেরণের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে আহবায়ক করে একটি ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। আর এই কমিটি সদর উপজেলায় গোয়ালিয়া খোলায় ভূমি দেখলেও শিল্প নগরীর জন্য স্থান নির্ধারণ করতে পারেনি।
এই ব্যাপারে বান্দরবান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন এর ভারপ্রাপ্ত উপ ব্যবস্থাপক মো: শামীম আলম বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বান্দরবানে শিল্প নগরী খুব প্রয়োজন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু ভূমি না পাওয়ার কারনে করা যাচ্ছেনা।
আরো জানা গেছে, এছাড়া কুটির শিল্প করর্পোরেশনের ৯ একর জায়গা বান্দরবান সদর উপজেলার আদিবাসী পল্লী ফারুক পাড়ায় আছে, এরি মধ্যে বেশ কিছু জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। একটি শিল্প নগরী করতে যাতায়ত সুবিধাসহ কমপক্ষে ২০ থেকে ৫০ একর ভূমির প্রয়োজন হয়।
প্রতিবছর যথাযথ সংরক্ষনের অভাবে বান্দরবানে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফল নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকরা তাদের কৃষিপণ্য অল্প দামে বিক্রি করে দেয়, পায়না তাদের ন্যায্য দাম। পরের বছর কৃষকরা তাদের উক্ত কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে উৎসহ হারিয়ে ফেলে।
স্থানীয় প্রশাসনের অসহযোগীতা এবং সরকারী উদ্দ্যেগের অভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছেনা শিল্প নগরী। আর প্রস্তাব পাঠিয়ে দায় শেষ করার অভিযোগ রয়েছে বান্দরবান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন কর্তাদের বিরুদ্ধে।
শিল্প নগরী স্থাপনের অগ্রগতির বিষয়ে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি পাহাড়বার্তা’কে বলেন, শিল্প নগরী করার বিষয়ে নতুন কোন অগ্রগতি নেই, মন্ত্রণালয় থেকে কোন পত্রও দেওয়া হয়নি।
এদিকে স্থানীয়রা মনে করছে, বান্দরবান পার্বত্য জেলায় শিল্প নগরী গড়ে না উঠায় জেলার কাঙ্খিত উন্নয়নের সুফল পাচ্ছেনা।
এই বিষয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা পাহাড়বার্তা’কে বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে জায়গা চেয়ে কোন পত্র পায়নি, পত্র দেওয়া হলে জায়গার ব্যবস্থা করা হবে।