পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও হেডম্যান নেতারা জানিয়েছেন, ১৯০০ সালের ‘হিলট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল’-এর ৪৮ ধারা, ১৯৯৭ সালের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’,১৯৯৮ সালের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ’ এবং ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ আইনকে পাশ কাটিয়ে অত্যন্ত গোপনে ২০১৭ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। যেখানে আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং তিন সার্কেল চীফের মতামত চাওয়া হয়নি। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর মানে কাপ্তাই বাঁধের মতো একটি অকল্যাণকর সিদ্ধান্ত পাহাড়ি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার শামিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৭ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় শাখা-২ থেকে উপ-সচিব শাহানারা বেগম লিলি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে একটি দাপ্তরিক চিঠি প্রেরণ করেন। যেখানে ২০১৭ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে গৃহীত হেডম্যানদের নিয়োগ স্থায়ী ও রাজস্বভুক্তি করে বদলি ও পদায়নের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মতামত প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, একই বিষয়ে চলতি বছরের ২৫ এপ্রিলও একটি চিঠি দেয়া হয়েছিল। এরপর আঞ্চলিক পরিষদ থেকে এ বিষয়ে তিন সার্কেল চীফের কাছে মতামত চাওয়া হলে বিষয়টি জানাজানি হয়।
সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের প্রকল্প কর্মকর্তা জয় প্রকাশ ত্রিপুরা জানান, সিদ্ধান্তটি একবছর আগে হলেও রহস্যজনক কারণে এতে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। আর এতে সন্দেহ সৃষ্টি বা ভুল বোঝাবুঝির যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে।
খাগড়াছড়ি হেডম্যান এসোসিয়েশনের সা: সম্পাদক স্বদেশ প্রীতি চাকমা বলেন, হেডম্যানরা স্বাধীন এবং সার্বভৌম অবস্থায় সরকারকে শত বছরের বেশি সময় ধরে সহযোগিতা করে আসছে। পাড়া প্রধান কার্বারীদের মাধ্যমে অর্পিত পালনে ব্যত্যয় করলে তার জন্য তো নিয়োগ কর্তৃপক্ষ হিশেবে জেলা প্রশাসকের ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। তাই বলে আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করে কোন সিদ্ধান্তকে তো ইতিবাচক ভাবার সুযোগ থাকল না।
রাঙামাটি জেলা হেডম্যান এসোসিয়েশনের সা: সম্পাদক জোর্তিময় চাকমা কেরল বলেন, ২০১৭ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনের কোন একদিন ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত নির্ধারিত সভায় তিন পার্বত্য জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসকরা বিষয়টি উত্থাপন করলে তা সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়। বিষয়টি অনেক আগে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানলেও রহস্যজনক কারণে তা ঝুলিয়ে রেখেছেন। আসন্ন ২০১৮ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলন ঘিরে বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।
তিনি দাবি করেন, একটি অদৃশ্য শক্তি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে পাশ কাটিয়ে গোপনে এই বির্তকিত সিদ্ধান্তটি কার্যকর করার মাধ্যমে পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও হেডম্যান নেতা শক্তিপদ ত্রিপুরা বলেন, ২০১২ সালে গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিন পার্বত্য জেলার সব হেডম্যান ও কার্বারী (পাড়া প্রধান)-দের সাথে আন্তরিকতাপূর্ন পরিবেশে মতবিনিময় করেছেন। তাঁর সদিচ্ছায় হেডম্যানদের সম্মানী পাঁচ’শ থেকে দেড় হাজার এবং কার্বারীদের সম্মানি দুই’শ থেকে পাঁচ’শ টাকা করা হয়েছে। সেসময় আমাদের অনেক দাবি-দাওয়া পর্যায়ক্রমে পূরণের আশ্বাস ছিল। কিন্তু সেসব বাদ দিয়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের এই সিদ্ধান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র মূল চেতনার পরিপন্থী।
এ বিষয়ে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো: রাশেদুল ইসলাম বলেন,বিষয়টি সরকারি নীতি নির্দারক পর্যায়ের। কাগজপত্র না দেখে এখনই মন্তব্য করার মতো সময় আসেনি।
অবশ্য রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ বলেন, এটি একটি প্রস্তাবিত বিষয়। সরকারি যে কোন সিদ্ধান্ত কার্যকর করার অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। আগামী সম্মেলনে মতামত উপস্থাপনের সুযোগ আছে। তাই কারো কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
এদিকে গত শনিবার বিকেলে খাগড়াছড়ি জেলাশহরে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের উপস্থিতিতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, হেডম্যানরা তিন পার্বত্য জেলার প্রাচীনতম প্রথাগত সামাজিক নেতৃত্ব। স্ব স্ব মৌজার সার্বিক কর্মকান্ডে তাঁদের একটি সম্মানজনক অবস্থান রয়েছে। তাঁদেরকে সরকারি কর্মচারি বানালে সামাজিক মর্যাদা যেমন ক্ষুন্ন হবে তেমনি জনমনে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।
একইসাথে হেডম্যান হিশেবে দায়িত্ব পালনকারী কংজরী চৌধুরী যোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী এরিমধ্যে হেডম্যানদের অনেকগুলো সমস্যা সমাধান করেছেন। হেডম্যানরা তাঁদের ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে পালন করে চলেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: নুরুল আমিন বলেন, আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার আগেই চিঠিটি এসেছিল। যেহেতু বিষয়টি আইন অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের এখতিয়ারভুক্ত। তাই আগামী জেলা প্রশাসক সম্মেলনকে সামনে রেখে তাঁদের মতামত চাওয়া হয়েছে।
তিনি দাবি করেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র ফলে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান ও আইনের ব্যত্যয় ঘটে, এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে না। সেক্ষেত্রে প্রায় চার’শ হেডম্যান বা মৌজা প্রধানদের মতামত উপেক্ষা করে কোন পদক্ষেপ নেয়ার কোনই চিন্তা পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের নেই।
উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ি জেলায় ১’শ ২১ জন, রাঙামাটি জেলায় ১’শ ৫৯ জন এবং বান্দরবান জেলায় ৯৫ জন হেডম্যান বা মৌজা প্রধান রয়েছেন। হেডম্যানরা সরকারি ভূমি উন্নয়ন কর, খাজনা, জুমকরসহ ভূমি ব্যবস্থাপনার কাজে জেলা প্রশাসক এবং সার্কেল চীফ বা রাজাদের সহযোগিতা করে থাকেন। বংশ পরম্পরায় সার্কেল চীপের সুপারিশক্রমে জেলা প্রশাসকরা হেডম্যান নিয়োগ দিয়ে থাকেন।