পাহাড়ে পুরানো রুপে ফিরে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কেএনএফ

সমঝোতা চুক্তি ভঙ্গ

NewsDetails_01

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে শান্ত ও সম্প্রিতির জেলা হিসাবে পরিচিত বান্দরবানে ২২ সাল থেকে কেএনএফ এর অপরাধমূলক কর্মকান্ড জেলাকে অস্থির করে রাখলেও শান্তি ফেরাতে উদ্দ্যেগ গ্রহনের পর শান্তির সমঝোতা অমান্য করে দুই উপজেলার রাতে ও দিনদুপুরে ব্যাংক থেকে অস্ত্র লুট ও অপহরণের ঘটনায় ফের আলোচনায় এসেছে কেএনএফ। আর এই ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, জেলায় শান্তি ফিরবে, নাকি শান্তিচুক্তি পূর্বাবস্থায় ফিরছে নাতো পাহাড়?

কারা এই কেএনএফ ?
‘কুকি-চিন রাজ্য’ নামে একটি পৃথক রাজ্যের দাবিতে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) পাহাড়ের ৯টি উপজেলা তাদের পূর্ব-পুরুষদের আদিম নিবাস, দখলদাররা তাদের ভূমি দখল করে নেয় এবং কোটাসহ সরকারি বিভিন্ন সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। জেএসএস’সহ অন্য সংগঠন গুলো তাদের ভূমি ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করে বিভিন্ন অপরাধ করছে, তাই এসব থেকে মুক্তি পেতে এই সংগঠন সৃষ্টি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাথান বম। সংগঠনটি ২০১৭ সালে কেএনভি নামে সশস্ত্র সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে শতাধিক সদস্য কাচিন, কারেন প্রদেশ এবং মনিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণে পাঠায়। ২০১৯ সালে কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষে শসস্ত্র অবস্থায় ফিরে আসে। রুমা সীমান্ত ও ভারতের মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত এ সংগঠনের সশন্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে মোট ৬শ এর বেশি সদস্য আছে। বর্তমানে তারা পাহাড়ের ৫টি উপজেলায় ঘাঁটি গেড়ে এসবিবিএল, একে ৪৭, এসএমজি, পিস্তল, নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরী ল্যান্ড মাইন্ড ব্যবহার করে অপরাধ মূলক কর্মকান্ডে জড়িত।

কেএনএফ এর যত অপরাধ:
কেএনএফ এর সংঘাতময় পরিস্থিতির কারনে ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে জেলায় পর্যটক যাতায়তে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা জারি ও পরে প্রত্যাহার করে জেলা প্রশাসন। পর্যটক যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞায় জেলার অন্তত দুই শতাধিক হোটেল-মোটেল কার্যত পথে পথে বসে, রুমার ৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাসের পর মাস বন্ধ থাকে। একই বছরের ১৫ নভেম্বরের পর ১৩২ টি পরিবারের ৫৪৮ জন ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নেয়। রুমা সদরে ১৪০ মারমা নারী-পুরুষ আশ্রয় গ্রহন করলেও তারা পরে বাসায় ফিরে যায়। ২৩ সালের ১০ মার্চ রাঙামাটির বিলাইছড়ির ৩টি পাড়া থেকে ৫৬ পরিবার রেইছা ও রোয়াংছড়ি সদরে আশ্রয় গ্রহন করে। এই ঘটনায় ৫ সেনা সদস্য নিহত ও কেএনএফ সদস্যসহ নিহত হয় আরো ১৬ জন, অপহরণের শিকার হয় অন্তত ৩০ জন। এর ফলে জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য ধস ও জনজীবনে অস্থিরতা বিরাজ করে। কেএনএফ এর সাথে জঙ্গী সংগঠনের যোগসাজস আছে দাবী করে যৌথ বাহিনী এসময় পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৬৮ জন জঙ্গী ও কেএনএফ এর বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়, এসময় বিপুল পরিমান অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

আলোচনায় ব্যাংক লুট:
গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ৫০-৬০ জনের সশস্ত্র দল রুমা সোনালী ব্যাংককে প্রবেশ করে। এসময় অস্ত্রের মুখে ব্যাংকের পাহারায় থাকা পুলিশ, আনসার সদস্যদের দুটি সাব-মেশিন গান ও এর ৬০ রাউন্ড গুলি, আটটি চাইনিজ রাইফেল ও এর ৩২০ রাউন্ড গুলি এবং চারটি শর্টগান ও ৩৫ রাউন্ড গুলি লুট করে তারা। এসময় ব্যাংক ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। গত ৩ এপ্রিল থানচির স্থানীয়দের জিম্মি করে গুলিবর্ষণ ও কৃষি ও সোনালী ব্যাংক লুট করে কেএনএফ সদস্যরা। আর বান্দরবানে এই ধরণের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতংকের পাশাপাশি ফের আলোচনায় কেএনএফ।

কেএনএফে কোন্দল!
বিভিন্ন দাবি নিয়ে শান্তির পথে ফিরে আসা ও না আসাকে কেন্দ্র করে কেএনএফে মত বিরোধকে কেন্দ্র করে ব্যাংক লুটের এই ঘটনা ঘটে বলে মনে করছে অনেকে। শান্তি প্রক্রিয়ার সমঝোতার মধ্যেই ব্যাংক লুটের ঘটনার পর শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির এক সদস্য এই ঘটনার বিষয়ে কেএনএফ থেকে জানতে চাইলে বর্তমানে ভারতের মিজোরামে অবস্থানরত কেএনএফ এর প্রধান নাথান বম এর উপদেষ্টা লালএংলিয়ান বম জানান, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা, আমরাও এই ঘটনায় হতবাক।

ব্যর্থ হবে শান্তি প্রক্রিয়া?
কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লার নেতৃত্বে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের নিয়ে ২০২৩ সালের জুন মাসে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। এরপর পর থেকে সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছে শান্তি কমিটি। এর ফলে পাহাড়ে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড ও আতংক কিছুটা কমে আসে। দুই পক্ষের মধ্যে একাধিকবার ভিডিও কনফারেন্সে বৈঠক হয়। এরপর গত বছরের ৫ নভেম্বর প্রথম সরাসরি বৈঠকে ৪টি বিষয়ে সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয়। গত ৫ মার্চ দ্বিতীয় বৈঠকে ৬ দফা দাবি আলোচনায় উপস্থাপন করা হয়। এই বৈঠকে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লার নেতৃত্বে ১৩ জন সদস্য অংশ নেন। আর এই শান্তি আলোচনার মধ্যে ব্যাংক লুট ও অপহরণের ঘটনায় শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হবে বলে মনে করছে অনেকে।

কেএনএফ এর সাথে শান্তি আলোচনা স্থগিত:
বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সাথে শান্তি কমিটির শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহব্বায়ক ক্য শৈ হ্লা।
আজ বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) সকালে পার্বত্য জেলা পরিষদ সভা কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা করেন।

NewsDetails_03

তিনি বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২৩ সালের ২৯ মে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে অরুণ সারকী টাউন হলে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৯ জুন স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফ এর মধ্যে কয়েক দফা ভার্চুয়াল মিটিং এর পর উভয় পক্ষের মতামতের ভিক্তিতে সরাসরি সংলাপে বসার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়।২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর এবং পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ মার্চ দু’দফা সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সংলাপে কেএনএফ এর সকল প্রকার সশস্ত্র কার্যক্রম হতে বিরত থাকা ও অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত দু’টি সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়।

কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে চুক্তি ভঙ্গ করে বিভিন্ন সময়ে সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। কমিটির তরফ থেকে এ বিষয়টির ব্যাপারে বারবার অবগতি করা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি তারা। বরং বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়বাসীদের উপর হামলা, চাঁদাবাজি, অপরহণসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে গেছে

তিনি আরো বলেন, সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল রুমায় সরকারি কর্মকর্তা ও পথচারীদের জিম্মি করে সোনালী ব্যাংকে হামলা, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪ টি অস্ত্র লুট করে নেওয়া এবং ৩ এপ্রিল থানচিতর স্থানীয়দের জিম্মি করে গুলিবর্ষণ ও কৃষি ও সোনালী ব্যাংক লুট করে কেএনএফ সদস্যরা।

যা বলছে প্রশাসনিক কর্তারা :
রুমা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাজাহান জানান, এবিষয়ে কোন প্রকার মামলা হয়নি, ব্যাংক ম্যানেজার উদ্ধারে কাজ চলছে, আটক করা হয়নি কাউকে।

এদিকে এই ঘটনায় শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে কিনা এই প্রশ্নে জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, চলমান শান্তি প্রক্রিয়ার সংলাপের মধ্যে কেন এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে তা আমরা খতিয়ে দেখছি।

এই ব্যাপারে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র, পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য কাঞ্চন জয় তংচঙ্গ্যা বলেন, এই ঘটনায় শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে, আমরা এই ঘটনায় স্থম্ভিত ও হতবাক, শান্তির সমঝোতা অমান্য করে তাদের এই ঘটনায় সবকিছু প্রশ্নবিদ্ধ।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা বলেন, অল্প সময়ে বড় অংকের টাকা জোগাড় করতেই, পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালায় কুকি চিন।

আইনশৃংখলায় প্রভাব পড়েছে কিনা এই প্রশ্নে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, এই ঘটনার পর সব সংস্থা একযোগে কাজ করছে, সবকিছু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি, এখনও আতংকিত হওয়ার মতো কিছুই নেই।

আরও পড়ুন