থানচিতে গাছ পাচারের মহোৎসব

জড়িত রক্ষকরা !

বান্দরবান পার্বত্য জেলায় অনায়াসে ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমিতে লাগানো গাছ কাটার নাম মাত্র অনুমতি পত্র (জোত পারমিট) দেখিয়ে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের মূল্যবান গাছ কেটে পাচার করা হচ্ছে। তার মধ্যে বেশির ভাগই দুর্গম অঞ্চল থানচি উপজেলায় থেকে অবৈধভাবে গাছ পাচারে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেসব কাজে দেখাশোনা দায়িত্বের রেঞ্জ কর্মকর্তারা নিজ কর্মস্থলে থাকার কথা থাকলেও অফিসে তারা ঠিক মতো বসছে না। খবর-মানবজমিন

অভিযোগ রয়েছে, থানচি রেঞ্জের দায়িত্বরত চার কর্মকর্তা নিজ অফিসে না এসে জেলা শহরের অফিসে বসে হিসাবনিকাশ করেন। শহরে বসে অফিসিয়াল কাজ দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে নাম মাত্র এক অফিসে কর্মচারীকে। সেই কর্মচারীর মাধ্যমে পুরো অফিসের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন এই ৪ রেঞ্জের কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, শহরে বসে থেকে গাছ পাচাকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে গাছ পাচারের সুযোগ দিচ্ছেন এই কর্মকর্তারা। সে সুযোগে শঙ্খ নদ বেয়ে আনা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতি গাছ। এই চক্রটির সঙ্গে বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে উজাড় হচ্ছে এসব গাছ।

এলাকাবাসীদের অভিযোগ, প্রতিদিন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আসে শঙ্খ নদ হয়ে। সেসব গাছ আসে রেমাক্রী প্রাংসা ও তিন্দু ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে। শহরে আশেপাশেও চলে গাছ কাটার মহোৎসব। কিন্তু সেসব গাছগুলো বেশির ভাগই নেই বৈধ কাগজপত্র। নির্বিচারে অবৈধ পন্থায় গাছ এনে দিনেরাতে পাচার করছে কিছু অসাধু চক্র। সেই অসাধু চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে মূলহোতা বন বিভাগে চার কর্মকর্তা। তাছাড়া এই কর্মকর্তারা ঠিকমতো অফিস করে না। অভিনব কৌশল খাটিয়ে অসাধু চক্রটি সেই সুযোগে অবৈধভাবে কাটা গাছ বৈধ হিসেবে পাচার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই কর্মকর্তারা অফিসে আসা দূরের কথা মাসিক সভাতেও উপস্থিত থাকেন না। প্রশাসন থেকে বারবার চাপ দিলেও অধিকাংশ সভাতে বন বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন না, মাঝে মধ্যে একজন আবার কখনো দু’জন। তাছাড়া বন রক্ষক হয়ে যখন ভক্ষকের মতন আচরণ করতে থাকে ঠিক তখনি এই কর্মকর্তাদের অবহেলায় উজাড় হচ্ছে গাছপালা আর হারাতে বসেছে পাহাড়ের বনাঞ্চল।

সূত্রে জানা যায়, বান্দরবানে থানচি উপজেলা বন বিভাগে ৪টি রেঞ্জ রয়েছে। থানচি সদর, সেকদু, রেমাক্রী প্রাংসা ও মিবাক্ষা রেঞ্জ। সেসব রেঞ্জের দায়িত্বে রয়েছে তৌহিদুল ইসলাম, সোহেল হোসেন, মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন ও মো. আলমগীর। নিয়মিত কর্মস্থলে না থেকে শহরে অফিসে বসে গাছের পারমিট করে দেন এই রেঞ্জের কর্মকর্তারা। তাদের অনুপস্থিতি ও গাফিলতির কারণে এই ৪টি রেঞ্জের অধীনে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বন বিভাগকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বন খেকোরা দিনের পর দিন বাগানের ছোটবড় গাছ নির্বিচারে কেটে পাচার করে দিচ্ছে। সরজমিন দেখা গেছে, পার্শ্ববর্তী এলাকাতে ছান্দাক পাড়া ব্রিজের নিচে গহিন জঙ্গল থেকে ঝিড়ি বেয়ে আসছে এসব গাছ। সেখানে তিনজন শ্রমিক নিয়োজিত আছে। এসব অবৈধ গাছের মালিক মং নামে পরিচিত। সেখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজনকে উপস্থিত দেখা যায়নি। প্রতিটি গাছের মধ্যে কোনো হ্যামার চিহ্ন ছিল না। সেসব গাছগুলো শঙ্খ নদ বেয়ে রেমাক্রী প্রাংসা হয়ে অবৈধ ভাবে খালের পাশে স্তূপ করে রেখেছে। এসব অবৈধ গাছের মালিক শহীদ মাস্টার বলে জানা গেছে।

NewsDetails_03

অন্যদিকে থানচি সদরে বনবিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, থানচি ব্রিজের নিচে থানচি সদর রেঞ্জের কার্যালয়। সেখানে দায়িত্বরত হিসেবে বোটচালক একজন রয়েছে। এ ছাড়া কার্যালয়ে কোনো রেঞ্জের কর্মকর্তাদের দেখা মেলেনি। শুধু এটি নয় সেকদু, মিবাক্ষ্যা ও রেমাক্রী প্রাংসা রেঞ্জের একই চিত্র। এই রেঞ্জের কর্মকর্তারা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় অবহেলিত ভাবে পড়ে আছে কার্যালয় ভবন। তাদের মাসের পর মাস ও দীর্ঘ বছর ধরে বন কর্মকর্তারা কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তাদের অবহেলায় ন্যাড়া পথে পাহাড়-বন প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। থানচি সদর রেঞ্জের বোটচালক (এসপিডি) ফরিদ মিয়া বলেন, অফিসে আমি একা থাকি দেখাশোনা করি আর রেঞ্জের কর্মকর্তারা শহর থেকে বসে গাছের পারমিট দেন। তারা মাঝে মধ্যে আসে, প্রয়োজন ছাড়া আসেন না। এ বিষয়ে জানতে রেমাক্রী প্রাংসা ও মিবাক্ষ্যা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. জসীম উদ্দিন ও আলমগীরের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও ফোনটি ধরেননি।

সেকদু রেঞ্জের কর্মকর্তা সোহেল হোসেন বলেন, আমি কর্মস্থলে যোগদান করেছি মাত্র দেড়মাস হলো। আমি নিজ কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করেছি। আর সেকদু রেঞ্জে কোনো পারমিট নাই। আর আমি প্রতিদিন কর্মস্থলে উপস্থিত থাকি বলে দাবি করেন এই রেঞ্জের কর্মকর্তা। থানচি সদর রেঞ্জের কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম টগর বলেন, আমার কাজ থাকলে যায় আর না থাকলে যায় না। অনুপস্থিত থাকার কারণ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, থানচি ও তারাছা দুটি রেঞ্জ আমার দায়িত্বে রয়েছে। দূরত্ব হওয়ার কারণে শহর বসে অফিস করছি।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম বলেন, প্রত্যেক রেঞ্জের কর্মকর্তারা স্ব স্ব কর্মস্থলে থাকার জন্য সরকার চাকরি দিয়েছে। নিজের কর্মস্থলে না থেকে শহরে বসে অফিস করা মানে বেআইনি কাজ করছে। তাদেরকে যদি চিহ্নিত করতে পারি তাহলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমি তথ্য পেয়েছি যে রেঞ্জের কর্মকর্তারা কর্মস্থলে উপস্থিত থাকেন না। সে বিষয়ে ডিভিশনাল কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থিত থাকার জন্য দু’টি চিঠি দিয়েছি। যদি প্রমাণ করতে পারি তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আরও পড়ুন